নিরাপদ স্থানে ২৮ নাবিক

চেষ্টা হচ্ছে তাদের পোল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজটি পরিত্যক্ত

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৪ মার্চ, ২০২২ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ রকেট হামলায় অচল হয়ে যাওয়ায় গতকাল পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। জাহাজ থেকে ২৮ নাবিককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। একই সাথে সরিয়ে নেয়া হয়েছে রকেট হামলায় নিহত জাহাজটির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাদিসুর রহমানের (৩৩) মরদেহও। গতকাল স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তাদেরকে জাহাজ থেকে সরিয়ে স্থানীয় একটি বাংকারে নিয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে পোল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিষয়টি দেখভাল করা হচ্ছে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘পোল্যান্ডে আমাদের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা জানিয়েছেন, ‘কিছুক্ষণ আগে আমরা জাহাজের বাকি ২৮ জন নাবিককে একটা সেফ জোনে নিয়েছি। তারা নিরাপদে আছেন এবং তারা তাদের সহকর্মী হাদিসুর রহমানের মরদেহও বহন করছেন। আমরা খুব দ্রুততার সাথে তাদের ওয়ারশ নিয়ে আসার চেষ্টা করছি এবং সেটা নিয়ে আসতে পারলে শিপিং মিনিস্ট্রির সঙ্গে আলোচনা করা হবে। সম্ভবত সকলকেই মরদেহসহ বাংলাদেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। পোল্যান্ডে অবস্থানকালীন হাদিসুরের নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করা হবে। লেটেস্টটা হল যে তারা এখন সকলেই নিরাপদে আছেন।’
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মালিকানাধীন কার্গো জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ২৯ জন ক্রু নিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে পৌঁছে। সিরামিক তৈরির কাঁচামাল নিয়ে জাহাজটি ২২ ফেব্রুয়ারি বন্দর ত্যাগের কথা ছিল। ওলভিয়া বন্দর কর্তৃপক্ষের পাইলট না পাওয়ায় জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করতে পারেনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ায় জাহাজটি আর বন্দরের বাইরে আসতে পারেনি। এই অবস্থায় জাহাজটি আরো ২২টির মতো জাহাজের সাথে ওলভিয়া বন্দরে আটকা পড়ে। সিংগাপুর ভিত্তিক ডেনমার্কের ডেল্টা শিপিং নামের একটি কোম্পানি বিএসসির কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে (চার্টার) জাহাজটি পরিচালনা করে। গত ২৬ জানুয়ারি জাহাজটি ভারতের মুম্বাই বন্দর থেকে যাত্রা করে সুয়েজ খাল হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের এরগলি বন্দরে পৌঁছে। সেখান থেকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরে গিয়ে ভাগ্য বিপর্যয়ের কবলে পড়ে।
বুধবারে রাতে (২ মার্চ) জাহাজটি রকেট হামলার শিকার হয়। এতে জাহাজটির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাদিসুর রহমান ঘটনাস্থলে নিহত হন। রকেট হামলায় জাহাজটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাহাজের ক্যাপ্টেনসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্বৃতি দিয়ে ক্যাপ্টেন আতিক জানান, রকেট হামলায় জাহাজটি পুরোপুরি অচল হয়ে গেছে বলা যায়। এটির নেভিগেশন সিস্টেম ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই জাহাজটিকে সমুদ্রপথে বের করে আনা সম্ভব হবে না। জাহাজটি মেরামত করার মতো অবস্থাও ইউক্রেনে বর্তমানে নেই। যুদ্ধ থামার পর পরিস্থিতির উপরই জাহাজটির ভাগ্য নির্ভর করবে।
জাহাজটির মেইন পাওয়ার জেনারেটর কাজ করছে না। শুধু ইমার্জেন্সি জেনারেটর কাজ করছে। এতে জাহাজটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখাও সম্ভব হবে না।
ইউক্রেনের বর্তমান তাপমাত্রা শূণ্যের কাছাকাছি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই পানি খুবই ঠাণ্ডা এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে তুষারপাতের আশংকা রয়েছে। শিপের হিটিং সিস্টেম কাজ করছে না। গরম পানির সিস্টেমও নষ্ট হয়ে গেছে।
একোমোডেশন বা রুমগুলোতে হিটিং সিস্টেম অচল হয়ে পড়েছে। জাহাজটির রেফ্রিজারেটর কাজ না করলে শুকনা খাবার ছাড়া বাকি তরকারি, মাছ, মাংস, দুগ্ধজাত সব খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি সবই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মূল জেনারেটর ফেল করায় রান্নার কাজে ব্যবহার করার যে ইলেকট্রিক চুলা, সেটাও কাজ করছে না। অগ্নি নির্বাপনের জন্য ব্যবহৃত হওয়া সব পানি ব্রিজ হতে নেমে শিপের বাসস্থানের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে রয়েছে। সবকিছু মিলে অচল জাহাজটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ভয়াবহ অবস্থার মাঝে জাহাজের নাবিকেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদেরকে উদ্ধার করার আকুতি জানিয়ে একের পর এক পোস্ট দিচ্ছেন। তাদের অনেকেরই আত্মীয় স্বজন নগরীর বিএসসি ভবনে এসে খোঁজ খবর নেয়ার পাশাপাশি কান্নাকাটি করছেন। গতকাল একাধিক স্বজনকে বিএসসি ভবনে কান্নাকাটি করতে দেখা গেছে। গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক (বাণিজ্য) ড. পীযূষ দত্ত সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, জাহাজটিতে পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে। নাবিকদের উদ্ধারে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিষয়টি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কাজ করা হচ্ছে।
রাতে ড. পীযূষ দত্ত দৈনিক আজাদীকে বলেন, জাহাজটির ২৮ জীবিত নাবিককে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদেরকে জাহাজ থেকে নামিয়ে স্থানীয় একটি বাংকারে রাখা হয়েছে। গতকাল ইউক্রেনের সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তাদেরকে জাহাজ থেকে টাগবোটের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়। একই সাথে জাহাজটির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হাদিসুর রহমানের মরদেহও স্থানান্তর করা হয়েছে।
নাবিকেরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে রয়েছেন। তাদের মানসিক অবস্থা আমরা বুঝতে পারছি। তাদের আতংকও অস্বাভাবিক নয়। তবে আমরা তাদের নিরাপদে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ড. পীযূষ দত্ত বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন বলে শুনেছি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে তৎপর রয়েছেন।
তিনি নাবিকদের স্বজনদের আতংকিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিএসসি সূত্রে জানা গেছে যে গতকাল নিম্নোক্ত নাবিকদের জাহাজ থেকে নামিয়ে বাংকারে রাখা হয়েছে।
জাহাজের মাস্টার জিএম নুর ই আলম। সিডিসি নম্বর ৪৭৪২। ১০ মার্চ ২০২১ থেকে তিনি এই জাহাজে কর্মরত। এমডি মনসুরুল আমিন। এডিশনাল মাস্টার। সিডিসি ৪২৭১। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ থেকে এই জাহাজে কর্মরত। সেলিম মিয়া। এসিও। সিডিসি নম্বর ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে কর্মরত।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। সেকেন্ড অফিসার। সিডিসি নম্বর ৬৩৭০। ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে এই জাহাজে কর্মরত।
এমডি রুকনুজ্জামান রাজিব। থার্ড অফিসার। সিডিসি নম্বর ৯৬৩৭। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে কর্মরত।
ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি। ডিসি-১। সিডিসি নম্বর ১০৬৯৮। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে এই জাহাজে কর্মরত।
ফয়সাল আহমেদ সেতু। ডিসি-২। সিডিসি নম্বর ১০৮৭৬। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে কর্মরত।
মোহাম্মদ ওমর ফারুক। চিফ ইঞ্জিনিয়ার। সিডিসি নম্বর ৪১০৪। ১৬ মার্চ ২০২১ থেকে কর্মরত। সৈয়দ আরিফুল ইসলাম। এডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার। সিডিসি নম্বর ৬৩৪৮। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে কর্মরত।
রবিউল আউয়াল। সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। সিডিসি ৬৬৩২। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে কর্মরত।
সালমান সারোয়ার সামি। চতুর্থ ইঞ্জিনিয়ার। সিডিসি ৯৪২১। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে কর্মরত।
ফারজানা ইসলাম মৌ। ইসি-১। সিডিসি ১০৮১৪। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে কর্মরত।
মোহাম্মদ শেখ সাদি। ইসি-২। সিডিসি ১০৮৯৬। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে এই জাহাজে কর্মরত।
মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সিডিসি ৫৬৯০। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে এই জাহাজে কর্মরত।
জামাল হোসাইন। বসুন। বিএসসি টি ১১২০। ১২ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে জাহাজে কর্মরত।
মোহাম্মদ হানিফ। এবি-১। সিডিসি ১৩৮১৩। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ থেকে জাহাজে কর্মরত। মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। এবি-২। সিডিসি ৩২২৩৬। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ থেকে জাহাজে কর্মরত।
মহিন উদ্দিন। এবি-৩। বিএসসি ১১১২। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে জাহাজে কর্মরত।
হোসাইন মোহাম্মদ রাকিব। ওএস-১। টি ৩৩৮৮৫। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ থেকে জাহাজে কর্মরত।
সাজ্জাদ ইবনে আলম। ওএস-২। টি ৩৩৭৬১। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ থেকে কর্মরত।
নাজমুল উদ্দিন। ফিটার। টি ৩৩৭২৪। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ থেকে জাহাজে কর্মরত।
মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। ইলেকট্রিশিয়ান। বিএসসি ১১২০। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে জাহাজে কর্মরত।
সারোয়ার হোসাইন। অয়েলার-১। বিএসসি ১১১৫। ৬ অক্টোবর ২০২১ সালে জাহাজে কর্মরত।
মাসুম বিল্লাহ। অয়েলার-২। বিএসসি ৩২৯২৬। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ থেকে জাহাজে কর্মরত।
মোহাম্মদ হোসাইন। অয়েলার-৩। সিও ৭৫১৪। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে জাহাজে কর্মরত।
মোহাম্মদ আতিকুর রহমান। ফায়ারম্যান। টি ৩৪২১৮। ৬ অক্টোবর ২০২১ থেকে জাহাজে কর্মরত।
মোহাম্মদ শফিকুর রহমান। চিফ কুক। টি ২৯৬১২। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে কর্মরত। মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। জিএস। টি ১৪২০৮। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে এই জাহাজে কর্মরত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়
পরবর্তী নিবন্ধপেকুয়ায় আরো একটি অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান