নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনায় সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনা দরকার

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

একটি দেশ কতটুকু উন্নত তার প্রমাণ পাওয়া যায়, রাস্তাঘাটে তারা কতটা সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করে তার উপর। আমাদের দেশে নগর বন্দর শহরে যত দ্রুতগামী যানবাহনে চলাচল করুন না কেন, গন্তব্যে পৌঁছাতে আপনাকে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অধিক সময় ব্যয় করতে হবে। যার প্রধান কারণ সড়কমহাসড়কে অতিধীর গতিসহ বিভিন্ন গতির হরেক রকম যানবাহনের আধিক্য। তার উপর রয়েছে প্রচুর আনাড়ি ও অদক্ষ ড্রাইভার। মাঝেমধ্যে ড্রাইভারদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো দেখে মনে হয়, তারা রাস্তায় গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

কয়েকদিন আগে প্রাইভেট গাড়ি করে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। খুব ভোরে রওয়ানা দিয়ে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগে কক্সবাজার পৌঁছাতে। পুরো রাস্তায় সিএনজি অটোরিকশা ও ব্যাটারী চালিত রিক্সার জন্য গাড়ি চালানো খুবই বিপদজ্জনক মনে হলো। এই দীর্ঘ পথে এক কিলোমিটার রাস্তা ফাকা ছিলো না ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও সিএনজি আটো রিক্সা ব্যতিত।মাঝেমধ্যে এমন অবস্থায় উপনীত হতে হয়েছে যেন এখনই দুর্ঘটনা ঘটবে।এই ধরনের মহাসড়কে যেখান দ্রুতগামী গাড়ি চলাচল করে, সেখানে এই ধরনের ছোট যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা একসময় অকেজো হয়ে পড়বে।

দেশে বৈধ যানবাহন আছে ৬২ লাখের মতো। আর সরকারের বিবেচনায় ‘অবৈধ’ যানবাহন আছে প্রায় ৭০ লাখ। বৈধ যানের মাত্র ২% এর কম বাসমিনিবাসসহ গণপরিবহন। চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের এই স্বল্পতার সুযোগে কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ তিন চাকার ব্যাটারি ও ইঞ্জিনচালিত রিকশায় ঢাকা চট্টগ্রাম সহ সারাদেশ ছেয়ে গেছে।একসময় সরকার এসব অবৈধ যান বাড়তে দিয়ে এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ত্রুটিপূর্ণ এই যানবাহনগুলো প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। কয়েকদিন আগে ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু চালকদের আন্দোলনের ফলে সেটি বাস্তবায়ন করা যায় নাই।

এদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে দেশে সড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায়। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তিন চাকার যানবাহনের দুর্ঘটনা। গতবছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছেন। যানবাহনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১ হাজার ৯২৪ জন। যা মোট নিহত হওয়া মানুষের ৩৪.৩৬%। আর তিন চাকার যানবাহন সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, নছিমন, অটোভ্যান ইত্যাদির দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৭ জন মারা গেছেন। যা মোট নিহত মানুষের ১৯.৫৯%

ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও অন্যান্য অবৈধ তিন চাকার যানবাহনের প্রকৃত হিসাব সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। ২০১০ সালের দিকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকে তিন চাকার অবৈধ যানের সংখ্যা ১০ লাখের মতো বলে উল্লেখ করা হয়। তবে বর্তমানে বিআরটিএ, যাত্রী অধিকার সংগঠন, পুলিশ ও অন্যান্য অংশীজনের হিসাবে ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত তিন চাকার অবৈধ যানবাহন এখন ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে আছে প্রায় ৫০ লাখ। আর ঢাকায় আছে ১০ লাখের মতো। তবে কেউ কেউ মনে করেন, ঢাকায় ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত রিকশার সংখ্যা ১৫ লাখের কম হবে না।

তিন চাকার এই যানবাহনগুলোর কাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। নানান ত্রুটিযুক্ত বিপুল পরিমাণ এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদের সুপারিশ,এটিকে নীতিমালার আওতায় এনে কারিগরিভাবে উন্নয়ন করা যেতে পারে। কোন কোন সড়কে, কী পরিমাণে চলতে দেওয়া হবে, এর একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকা দরকার।

এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২০ ধরনের যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। গত অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহন হচ্ছে ৬২ লাখ। এর মধ্যে গণপরিবহনের মূল বাহন বাসমিনিবাস আছে মাত্র ৮৪ হাজার। তিন চাকার যানবাহনের মধ্যে শুধু অটোরিকশা ও অটোটেম্পোর নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এ দুটি যানের বৈধ সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৪২ হাজার। অন্যদিকে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ তিন চাকার ছোট যানবাহন চলাচল করে। এগুলোকে সরকার অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করে। এসব যানের মধ্যে রয়েছে নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি, ইজিবাইক ও পাখি। সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশা। নানা ত্রুটিযুক্ত বিপুল পরিমাণ এসব যানের চলাচল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই যানবাহনগুলোর সঙ্গে যে পরিমাণ মানুষ যুক্ত রয়েছে এবং যেভাবে ছড়িয়েছে, তা হুট করে বন্ধ করা যাবে না। আবার অবৈধ এসব তিন চাকার যানবাহন চলাচলের পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী বা রাজনীতিকেরা জড়িত। অবৈধ এই যানের চলাচল বহাল রাখতে বিপুল চাঁদা দিতে হয় চালকমালিকদের। আর এই চাঁদার ভাগীদার স্থানীয় টাউট বাটপার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে রাজনীতিকেরা।

একসময় এসব ব্যাটারী চালিত রিকশা চলত শহরের অলিগলিতে। এখন ছড়িয়ে পড়েছে সড়ক মহাসড়কে। এসব গাড়ির বড় সমস্যা হলো এগুলো ৪০৫০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। কিন্তু এর ব্রেক সিস্টেম খুবই দুর্বল। হঠাৎ ব্রেক করলে উল্টে যায় এবং এতে অনেক প্রাণহানিও ঘটছে প্রতিনিয়ত। এর চালকেরা সব অনভিজ্ঞ, এরা কোন ট্রাফিক নিয়ম কানুন জানেও না মানেও না। হঠাৎ যে কোন সময় মোড় নিয়ে অন্যান্য গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আর একটি বড় সমস্যা হলো এগুলোর যত্রতত্র পার্কিং ও গতির প্রতিযোগিতা। যে কোন রাস্তায় দুই তিন লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকে এসব গাড়ি। ফলে সড়ক মহাসড়কসহ সব জায়গায় যানজটের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায় এইসব গাড়ি। আবার এসব গাড়ির চার্জের জন্য যে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তার বেশিরভাগই অবৈধ সংযোগ থেকে করা হয়। দেশে যে বিদ্যুতের উপর চাপ তার একটা বড় কারণ হলো এইসব ব্যাটারী চালিত আটোরিক্সার চার্জের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের চাহিদা। তাই সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এসব অবৈধ যানের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অথবা এসব যানের কারিগরি ত্রুটি দূর করে নিরাপদ যান হিসাবে চলাচলের ব্যবস্থা করা এবং নিবন্ধনের আওতায় এনে রাজস্ব আহরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এগুলোর চলাচল নিয়ন্ত্রিত করে সড়ক মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ করা। প্রয়োজনবোধে সরকার সব স্টক হোল্ডারের মতামতের ভিত্তিতে দীর্ঘ ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসে এর সুষ্ঠু সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবার সমাজ ও শাসন ব্যবস্থায় সুন্দর সুশৃঙ্খল বিন্যাস থাকা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধআত্মমগ্ন কবি-শিল্পী-গীতিকার অধ্যাপক আবু জাফর