চার ওয়াসার কৌশলগত অংশীদারত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সেমিনারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম স্যুয়ারেজ সার্ভিস দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক ওয়াসাকে তাদের সকল কার্যক্রমে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। গ্রাহকসেবা সহজীকরণ করতে হবে। তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ দেশের সকল ওয়াসাকে স্যুয়ারেজ সার্ভিস দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। গত শনিবার সকালে চিটাগাং ক্লাবে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার আয়োজনে দেশের চার ওয়াসার কৌশলগত অংশীদারত্ব নিয়ে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রী বলেন, এক সময় মানুষ পানির জন্য কলসি নিয়ে মিছিল করলেও সে চিত্র বর্তমান বাংলাদেশে নেই। কারণ ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসা স্থানীয় জনগণের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ঠিকভাবে করতে পেরেছে। এছাড়াও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিকরণ করার জন্য চট্টগ্রাম ও ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।
ওয়াসার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বর্তমানে নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পানি নিঃসৃত হয়ে নদীতে পড়ছে। ২০৩০ সালে এর পরিমাণ প্রতিদিন ৫১৫ মিলিয়ন লিটার হবে। এছাড়া নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৫৩৯ ঘনমিটার ফিক্যাল স্ল্যাজ সেপটিক ট্যাংকে জমা হচ্ছে যা আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ৭১৫ ঘনমিটার হবে। ফলে নদীর পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে যা সার্বিক ভাবে চট্টগ্রামের পরিবেশ দূষণ করছে এবং ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহে সংকট সৃষ্টির শংকা রয়েছে। পরিকল্পিত কোনো স্যুয়েরেজ সিস্টেম গড়ে না ওঠায় বছরের পর বছর ধরে টয়লেটের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম মহানগরী শূন্যের কোটায় রয়েছে। যা ঘুরে ফিরে উন্মুক্ত মলমূত্র ত্যাগের মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, ‘সুয়্যারেজে ঢাকা থেকে ১০৩ বছর পিছিয়ে চট্টগ্রাম। ঢাকা ওয়াসা ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঢাকায় সুয়্যারেজ সিস্টেম চালু হয় ১৯২৩ সালে। ৫০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তারা এই সুয়্যারেজ প্রকল্প চালু করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে ব্যাপকহারে সুয়্যারেজ সিস্টেম চালু করে ঢাকা ওয়াসা। এখন পর্যন্ত ঢাকার ২০ শতাংশ এলাকা সুয়্যারেজের আওতায় এসেছে। কিন্তু দেশের দ্বিতীয় প্রধান নগরী চট্টগ্রামে ১৯৬৩ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলেও দীর্ঘ ৫৯ বছর সুয়্যারেজ নিয়ে অন্ধকারেই ছিল চট্টগ্রাম।’
বিশেষজ্ঞরা চট্টগ্রামের উন্নয়নে বেশ কয়েকটি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন অনেক আগে। সমস্যাগুলো হচ্ছে– নগরীর মাস্টারপ্ল্যানকে অবহেলা করে প্রায় সব প্রকল্প গ্রহণ, নগরীর গভর্ন্যান্স ও উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৮টি সংস্থা ও এজেন্সির মধ্যে সমন্বয়ের সার্বক্ষণিক সংকট, ড্রেনেজ সমস্যা সমাধানের নামে অপরিকল্পিত প্রকল্পে বিপুল অর্থ অপচয়, স্টর্ম–স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার অভাব, খাল–নালা দখল, কর্ণফুলী নদীদূষণ, যত্রতত্র অপরিকল্পিত ফ্লাইওভার ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, যত্রতত্র শপিং সেন্টার নির্মাণ, নগরীতে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র ও খেলার মাঠের স্বল্পতা প্রভৃতি। বিশেষজ্ঞদের এসব মতামত সরকারকে বিবেচনায় আনতে হবে। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের সুয়্যারেজ ব্যবস্থা না থাকাতে নদী ও খাল দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিছু ক্ষেত্রে সুয়্যারেজের লাইনের সাথে পানির লাইন এক হয়ে দূষণ ছড়াচ্ছে। বস্তি ও প্রান্তিক বহু এলাকায় সুয়্যারেজ এর চরম ঘাটতি ও পানির অপ্রাপ্যতার সমস্যা বিদ্যমান। দেশের সকল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষত দুর্গম উপকূলীয় অঞ্চল, চর, হাওর, পাহাড়ি এলাকা, শহরের বস্তিবাসী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ নিম্ন আয়ের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীদের প্রতি বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী দ্রুতগতিতে সবাইকে নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের আওতায় আনতে হবে। ২০৩০ এর মধ্যে এসডিজি অর্জনের কঠিন পথ পাড়ি দিতে নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের গুণ ও পরিমাণগত মান নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। ওয়াসার পানির গুণগত মান নিশ্চিতকরণ ও পাইপ নেটওয়ার্কও খতিয়ে দেখা জরুরি। সিটি করপোরেশনের এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীকে পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন এবং ড্রেনেজ সেবা প্রদানে ওয়াসা’র সীমিত সম্পদ ও প্রযুক্তি সত্ত্বেও অদম্য প্রচেষ্টা চলমান। তবুও আরো মনিটরিং পূর্বক সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিতে ওয়াসাকে প্রাগ্রসর ভূমিকা রাখতে হবে।