তাহিয়া ও নিতু বিজয়নগর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। তারা বেশ ভালো বন্ধু। তাহিয়াদের বাড়ি গ্রামের দক্ষিণ মাথায় আর স্কুল উত্তর মাথায়। নিতুদের বাড়ি গ্রামের মাঝামাঝি। তাহিয়ার মা ঐ স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। তিনি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় তাহিয়ার সাথে নিতুকেও সঙ্গে করে নিয়ে যান। নিতুর বাবা বিদেশে থাকে। নিতুর ছোট একটা ভাই আছে সাথে বৃদ্ধ দাদী। তাই নিতুর মায়ের পক্ষে সবসময় নিতুর সঙ্গে স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়না। তাহিয়ার মা–ও নিতুর মায়ের ব্যাপারটা বুঝে নিতুকে নিজের মেয়ের সাথে প্রতিদিন ডেকে ডেকে স্কুলে নিয়ে যান। মেয়েটাও বেশ শান্তশিষ্ট। যে কেউ দেখলেই মায়া হবে। আর স্কুল শেষে ফেরার সময় নিতুকে সঙ্গে করে তাহিয়াদের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তাহিয়ার বড়ো বোন তানিয়ার কাছে বিকাল অবধি দু‘জন খাওয়া–দাওয়া, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে খেলাধুলা শেষে আবার বিকেলে নিতু অনেক সময় একা একাই বাড়ি চলে যায়।
সেদিন বিকেলে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তানিয়া ছাতায় ঢেকে নিতুকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। বৃষ্টি একটু বেশি হওয়ায় নিতুর স্কুল ব্যাগটা তাহিয়াদের বাসায়ই রেখে যায়।
বৃষ্টি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, চলতে থাকে বিরামহীন। মাঝ রাতে তাহিয়ার মায়ের ডাকাডাকিতে ঘরের সবার ঘুম ভেঙে যায়। উঠেই দেখে ঘরে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। জীবনে কখনো এমন বন্যা দেখেনি তাহিয়ার মা আর তার মেয়েদের তো দেখার প্রশ্নই আসেনা। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাহিয়ার মা। বেগতিক দেখে দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে একতলা বাড়িটার ছাদে ওঠার সিঁড়ির উপরে গিয়ে উঠলেন। অবিরাম বৃষ্টিতে কোনোরকম মোবাইলের আলোতে মেয়েদের নিয়ে রাত পার করেন। সকালে দেখতে পান বাসার ভিতরে বুক সমান পানি। বাসার জিনিসপত্র থৈথৈ পানিতে ভাসছে। ততক্ষণে মোবাইলের চার্জও ফুরিয়ে গেছে। কারো সাথে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি। শোনা যায় ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়ার পাশাপাশি অবিরাম বৃষ্টিই বন্যার মূল কারণ। এদিকে ঘরের খাবারও ফুরিয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে বিশুদ্ধ খাবার পানি, চুলা তলিয়ে গেছে পানির নিচে। বাচ্চাদের নিয়ে বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন তাহিয়ার মা। অতি কষ্টে খেয়ে না খেয়ে বাড়ির সিঁড়িতেই তাদের দিন কাটতে লাগলো। দু‘তিন দিন পর ত্রাণ নিয়ে নৌকায় চড়ে কিছু লোক আসলে তাদের কাছ থেকে কিছু খাবারের পাশাপাশি মোমবাতি, কয়েল, অষুধের সঙ্গে কিছুটা মানসিক শক্তিও খুঁজে পায় তাহিয়ার পরিবার।
কয়েকদিন পর ধীরে ধীরে বন্যার পানি সরে যায়, বিদ্যুৎ আসে এবং এলাকার পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তাহিয়ার মা তাহিয়াকে সঙ্গে করে নিতুর ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে স্কুলের দিকে রওয়ানা হলেন। নিতুদের বাড়ি পৌঁছতেই তাহিয়া মায়ের হাত থেকে নিতুর ব্যাগটা নিয়ে নিতুকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে নিতুদের ঘরের ভেতরে চলে যায়। কতদিন পর সহপাঠী, খেলার সাথী বনাম বান্ধবীর সাথে দেখা হবে যেন তর সয় না! ঘরের ভেতর যেতেই নিতুর মা তাহিয়াকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠোনে এসে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাহিয়ার মা দ্রুত তাহিয়াকে সামলে নিয়ে নিতুর মায়ের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করেন। নিতুর দাদী কোনোরকম দরজার কাছে এসে অস্পষ্ট স্বরে বলেন, “নিতু নাই, আমার নিতু বানের জলে ভাইসা গেছে।” সবশেষে নিতুর স্কুল ব্যাগটি বুকে চেপে তাহিয়ার মা তাহিয়াকে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কোনোমতে স্কুলের দিকে এগিয়ে যায় আর ভাবে স্কুলে গিয়ে যে, আর কতো নিতু হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাই না শুনতে হবে হে প্রভূ!