আজকের দিনে, নারীর সেলফ ডিফেন্স অর্থাৎ নারীর আত্মরক্ষার কলা-কৌশল জানা থাকা কতোটা প্রয়োজনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়ে, কর্মজীবী নারী যাদেরকে সপ্তাহের প্রায় প্রতিটি দিনই বাড়ির বাইরে পা রাখতে হয় তাদের জন্য সেলফ ডিফেন্স জেনে রাখাটা আবশ্যকীয়। কেননা বাইরে বেরুলেই তাদেরকে প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্বকে সামলে রাখার যুদ্ধ করতে হয়। লোকাল বাসে, হিউম্যান হলারে, পথ-চলতি ভিড়ে, নির্জন রাস্তার মোড়ের সুযোগ নিয়ে যাতে কোনো আপত্তিকর হাত তার দিকে ধাবমান না হতে পারে কিংবা এরকম প্রতিকূলতা উপস্থিত হলে যাতে তার মোক্ষম জবাবটি দিতে পারেন, সেই আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলার নামই সেলফ-ডিফেন্স।
পৃথিবীর প্রায় সবদেশে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে চর্চিত মার্শাল আর্টের নানা প্রকারের একটি হচ্ছে এই উইম্যান্স সেলফ ডিফেন্স বা নারীদের আত্মরক্ষা। আগেই উল্লেখ করেছি যে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে প্রতিজন নারীরই সেলফ ডিফেন্স জানা বা শেখা অত্যন্ত জরুরি। সংবাদপত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় হররোজই আমরা নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, বল প্রয়োগ ইত্যাদির কথা পড়ে থাকি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বহির্বিশ্বেও এরকম অনাচার ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।
পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের নারীদের কাছে এই বিষয়টি এখনও অজানা বা শৌখিন পর্যায়ে চর্চিত হচ্ছে। আত্মরক্ষার বিষয় হোক বা স্রেফ মার্শাল আর্টস শেখার বিষয়েও ছেলেদের থেকে মেয়েদের শেখার সংখ্যা খুবই কম। এর পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে যেমন অনেকেই ভাবেন, নারী প্রশিক্ষক হলে তবেই শিখবো। মজার ব্যাপার হলো, এটি শেখার বিষয়ে যদি মেয়েরা এগিয়ে না আসে তবে আমরা নারী প্রশিক্ষক পাবো কি করে? আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের দেশে এখনো অনেকেই ভাবেন যে, সেলফ ডিফেন্স হচ্ছে কারাতে ক্লাস! আর সেটা শিখে আমার মেয়ে কি রাস্তাঘাটে আত্মরক্ষায় কারাতে করবে! অনেকে এটা ভেবে ইতস্তত বোধ করেন যে, আমার যে বয়স তাতে কি আমি এসব শিখতে পারব? বা আমার শারীরিক গড়ন কি এরকম বিশেষায়িত কৌশল শেখার জন্য ফিট আছে! অর্থাৎ এমন অনেকেই আছেন যারা শেখার আগেই বিষয়টিকে অসম্ভব এবং কঠিন কাজ ভেবেই ভয় পেয়ে যান, পিছেয়ে আসেন। যারা এমনটি ভাবেন, তাদেরকে অবশ্যই অবশ্যই এমন অমূলক ভাবনাগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে, সেলফ ডিফেন্স শিখতে গেলে ভয়, লজ্জা এইগুলোকে কাটিয়ে উঠতে হবে।
নিয়মিত সেলফ ডিফেন্সের চর্চা কি কেবল বিপদের সময় আত্মরক্ষা করা? একেবারেই নয়, এটি নিয়মিত চর্চা করলে সুস্থ-সবল শরীর যেমন বজায় থাকে তেমনি আত্মবিশ্বাসও বাড়ে। আমরা তো হলফ করে বলতে পারি না যে কে কখন কোথায় কীভাবে বিপদে পড়বো। তাই এমন অনাহূত বিপদ মোকাবেলায় আমাদের সবসময় তৈরি হয়ে থাকাটা জরুরি। ফলে আত্মরক্ষার কিছু বেসিক টেকনিক বা মৌলিক কৌশল কিছু জানা থাকলেও সময়ে অনেক কাজে লাগবে। আজকাল অনেক মেয়ে এবং নারী আছেন যারা পড়াশোনার জন্য কিংবা চাকরিসূত্রে একা একা বাইরে থাকেন। সেটি যেমন দোষের নয় বরং নারী প্রগতিরই অংশ, তেমনি এই একা চলতে গিয়ে নারীদের নানান দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। এক্ষেত্রে সেল্ফ ডিফেন্স জেনে রাখলে, একা জীবনধারণে আত্মবিশ্বাস অনেকটাই চাঙ্গা থাকবে। এই প্রসঙ্গে পোশাক নির্বাচন নিয়ে একটি কথা শোনা যায় যে, যে কোনো পোশাক যেমন শাড়ি বা স্কার্ট পরিধেয় অবস্থায়ও কি সেলফ ডিফেন্সের কৌশলগুলো কাজ করে? এর উত্তরে বলব, সেলফ ডিফেন্সের কৌশলগুলো যে কোনো পোশাকেই আত্মরক্ষায় সহায়তা করে। যেমন শাড়ি বা স্কার্ট পড়া অবস্থায় আততায়ীর বিরুদ্ধে কি ধরনের অ্যাকশান নেওয়া যেতে পারে এবং হাতের কাছে যা আছে যেমন ক্লাচার, পেন, চুলের কাটা, চাবি, পেপার স্প্রে এইসব সেইমুহূর্তে কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে সেসবের ব্যবহারিক পাঠ দেওয়া হয় সেলফ ডিফেন্সের কোর্সগুলোয়। আবার আপনি যদি খালি হাতে থাকেন তখন কিভাবে রক্ষা পাবেন? পাঞ্চ বা ঘুঁষি, ব্যাক স্ট্রাইক বা পাল্টা আঘাত, গ্রাপলিং বা উল্টো জাপটে ধরা, কিক, আনহ্যান্ড বা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া, থ্রোইং এইসব কৌশল খুব সহজেই শেখা যায় এবং ব্যবহারও করা যায়।
আমরা তো শিশুকাল থেকে এই শিখেই বড় হই যে, পুরুষই হল নারীর রক্ষাকর্তা। চলচ্চিত্রে বা সাহিত্যেও এইরকম উদাহরণ প্রচুর। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণা আমাদের বদলাতে হবে। এই কথা সত্য যে, সমাজ নারীদের জন্য আজও সুরক্ষিত নয়। তাই প্রতিদিনই হেনস্তার শিকার হতে হয়। তাই বলে কি নারীরা বাইরে বের হবে না, নিজেকে অন্তপুরে আড়াল করে রাখবে? একদমই নয় বরং বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করতে নিজেকে সাহসী করে তুলবে। নারীরা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অফিসে যাবে, একা একা ঘুরতে যাবে, বন্ধুদের সাথে চায়ের টেবিলে আড্ডা দেবে। পাশাপাশি নিজেকে এরকমভাবেই প্রস্তুত করবে যেন সে নিজেই নিজের সুরক্ষা করতে পারে।