একুশে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেছেন, নিজের লেখা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে বেঁেচ থাকবেন চৌধুরী জহুরুল হক। তিনি যে উদ্দেশ্যে সাহিত্যকর্ম করেছেন তা যদি আমরা মনে রাখি তবেই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।
নাট্যকার চৌধুরীর জহুরুল হক স্মরণসন্ধ্যা- ২০২২ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ সব কথা বলেন আজাদী সম্পাদক। নাট্যমঞ্চ চট্টগ্রামের উদ্যোগে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদী মিলনায়তনে এ স্মরণসন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্মারক বক্তা ছিলেন কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য ড. মো. আবুল কাসেম। নাট্যমঞ্চ সম্পাদক জাহেদুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক সম্মাননা-স্মারক প্রদান করা হয় নাট্যজন মিলন চৌধুরী ও সাবরিনা সুলতানা বীণাকে। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন নাট্যজন সনজীব চৌধুরী। আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন নাট্য নির্দেশক দীপক চৌধুরী।
এম এ মালেক আরো বলেন, চৌধুরী জহুরুল হক চারিত্রিক এবং চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। তার নামের মধ্যে সে ব্যতিক্রমের ছোঁয়া। সাধারণত মানুষের নামের শেষে চৌধুরী থাকে। আমার মনে হয় তার বাবাও নাম জহুরুল হক চৌধুরী রেখেছেন। হয়তো মেট্রিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করার সময় তিনি চৌধুরী আগে নিয়ে এসেছেন। এখান থেকেই বুঝা যায় তার জীবনধারা ব্যতিক্রম ছিল।
স্মৃতিচারণ করে এম এ মালেক বলেন, চৌধুরী জহুরুল হকের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। জীবদ্দশায় প্রায় প্রতিদিনই দৈনিক আজাদী কার্যালয়ে আসতেন। আজাদী কার্যালয়ে আমাদের কতো যে দিন কেটেছে বলার অপেক্ষা রাখে না। তার চোঙ্গা গল্পও কোহিনূর প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছিল।
তরুণ লেখকদেরও পরামর্শ দেন আজাদী সম্পাদক। তিনি ভারতীয় লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, লেখকের সবচেয়ে বড় বন্ধু তার টেবিল। লিখতে পারেন বা না পারেন প্রতিদিন খাতা-কলম নিয়ে টেবিলে বসে যাবেন। সময় নিয়ে কয়েকদিন বসলে একদিন ঠিকই লেখা হয়ে যাবে।
শেক্সপিয়রের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে এম এ মালেক বলেন, পৃথিবীটাই একটা নাট্যমঞ্চ। আমরা যে যার মতো অভিনয় করে চলেছি। আর নাট্যাভিনেতারা আমাদের বাস্তব জীবনের সেই অভিনয় মঞ্চে ফুটিয়ে তুলেন নাটকের ভাষায়।
আইনস্টাইনকে উদ্ধৃতি করে এম এ মালেক বলেন, লেখাপড়া করে ভুলে যাওয়ার পর যেটা মনে থাকবে সেটাই জ্ঞান। আবার সত্যজিৎ রায় বলেছেন, ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’। সেটা কেন বলেছেন; এসব আসলে রূপক; আপনি যত বেশি জানবেন তত বেশি আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে। যত বেশি জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে তত বেশি আরো জানার জন্য উদগ্রীব হবেন। তখন আপনি বিশ্বকে কিছু দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমি আমার কাজকে সবসময় দায়িত্ব মনে করি। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স ছিল ২২ বছর। আমি চেয়েছি আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদীকে এগিয়ে নিতে। এবং এ পত্রিকার মাধ্যমে চট্টগ্রামের মানুষের কথা বলতে।
তিনি বলেন, প্রতিটি শহরে একটি করে ভয়েস থাকে। আমি বলি, আজাদী ইজ দ্যা ভয়েস অব চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের কণ্ঠস্বর বলতে যা বুঝি সেটা হচ্ছে দৈনিক আজাদী। আমরা চট্টগ্রামের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরি। চট্টগ্রামের মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার চেষ্টা করি। চট্টগ্রামের বিষয়কেই সবসময় আজাদীর প্রধান শিরোনাম করে থাকি। জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক বিষয়গুলো কম প্রাধান্য পায়। চট্টগ্রামের কোনো লোক মারা গেলে বা মৃত্যুসংবাদকেও আমরা গুরুত্ব দিয়ে ছাপাই। সে রিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়ি চালক বা বিত্তবান যেই হোক না কেন।
‘একটি আধুনিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা : ভারতবিভাগকালীন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাসেম বলেন, চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তুলনা বাংলাদেশের ইতিহাসেই শুধু নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসেও বিরল। সকল ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে সর্বাগ্রে থাকার চট্টগ্রামের যে ঐতিহ্যগৌরব তারই উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা রয়েছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও।
তিনি বলেন, জাতীয় আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর জন্য চট্টগ্রামে নজরুল জয়ন্তী, দাঙ্গাবিরোধী ইত্যাদির মত সাময়িক কর্মসূচি যেমন : গ্রহণ করা হয়েছিল, তেমনি আণবিক বোমার বিরুদ্ধে শান্তির সপক্ষে সমসাময়িককালে বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্বশান্তি পরিষদের মত স্থায়ী সংগঠনও গড়ে তোলা হয়েছিল। লেখক সাহিত্যিকেরাও থেমে ছিলেন না। তাঁরাও তাঁদের লেখনির মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলার কাজে সক্রিয় হয়েছিলেন সাহিত্য আসরে মিলিত হয়ে এবং পত্রপত্রিকার পাতায় লেখালিখির মাধ্যমে। বড় সড় সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে যোগ দিয়েছিলেন দেশবিদেশের সমমনা বড় মাপের প্রতিভাবান শিল্পীসাহিত্যিকগণ। জনমত গঠনের জন্য বিনোদনকলাকেও কাজে লাগানো হয়েছিল ব্যাপকভাবে। শিল্পকলা মানুষেরই জন্য, এই নীতির অনুসরণ করে অনেকগুলো নাট্যসংগঠন গড়ে উঠেছিল, যেগুলো মঞ্চায়ন করছিল জীবনঘনিষ্ঠ নতুন নতুন যুগোপযোগী নাটক। তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন কবিয়াল ও গণসঙ্গীত শিল্পীরাও। সবার সম্মিলিত আয়োজনে চট্টগ্রাম সে সময় দারুণভাবে মেতে উঠেছিল।
সনজীব বড়ুয়া সংবর্ধিত দুই অতিথির নানা গুণ তুলে ধরেন। তিনি সাবরিনা ইসলাম বীণার প্রশংসা করে বলেন, যে কোনো চরিত্র ধারণ করার ক্ষমতা আছে তাঁর। অনুষ্ঠানে নাট্যনির্দেশক মুনির হেলালের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আয়েশা হক শিমু।
জাহেদুল আলম বলেন, বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের নাটক রচয়িতা চৌধুরী জহুরুল হক। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নাটককে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। চট্টগ্রামেই প্রথম কাব্যনাট্য রচিত হয়, সেটা চৌধুরী জহুরুল হক গবেষণা করে প্রমাণ করেন।