সবসময় সবুজ পাহাড়ে চোখ থাকে ভূমিখেকোদের। চট্টগ্রামে পাহাড়ের বুক চিড়ে গড়ে ওঠা বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের দুই পাশের পাহাড়ে এবার চোখ পড়েছে ‘মাফিয়াদের’। ইতোমধ্যে অসংখ্য পাহাড়কে নিজেদের ব্যক্তি মালিকানাধীন দাবি করে পাহাড় চূড়া ও পাদদেশে টাঙানো হয়েছে অসংখ্য সাইনবোর্ড। নানান সিন্ডিকেট, গ্রুপ, ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের নামে ঝুলানো হচ্ছে এসব সাইনবোর্ড। মানবাধিকারের নামে বুলি ফোটানো লোকজনও জড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে সাইনবোর্ড ঝুলানোর কাজে। তবে এসব পাহাড় ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে, সাঁটানো সাইনবোর্ড অপসারণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার। যিনি চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।
চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডটি চট্টগ্রামের যোগাযোগে নতুনত্ব আনবে। এই রোডের দুই পাশের পাহাড়গুলোর মূল স্টেক হোল্ডার হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরকে আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে, এখানে যেটা সরকারি জায়গা, সেখানে যেই সাইনবোর্ড টাঙানো হোক না কেন, সকল অবৈধ দখলদারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এখানের পাহাড় ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাহাড়ি জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও প্রকৃতি নষ্ট করার কারো কোনো সুযোগ নেই।’ পাহাড় চূড়া ও পাদদেশে টাঙানো সাইনবোর্ডগুলো অপসারণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্পটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। তৈরি হয়েছে চার লেনের সড়ক। সড়কটি পুরোদমে ব্যবহার শুরু না হওয়ায় সড়কের দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছে। সবুজ পাহাড়ের বুক চিড়ে চলে যাওয়া সড়কটি এখন নগরীর মানুষের বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার পাহাড়গুলো সরকারি হলেও কিছু কিছু সিন্ডিকেট সরকারি বন্দোবস্তের সুযোগে নিজের নামে করে নিয়েছে পাহাড়গুলো। আইনের মারপ্যাঁচে অনেকে এসব পাহাড় ব্যক্তি মালিকানাধীন বানিয়ে বিক্রিও শুরু করে দিয়েছে। বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড হওয়ার কারণে আশেপাশের পাহাড়গুলোর কদর বেড়েছে কয়েক শত গুণ। এসুযোগে সবুজ পাহাড়গুলোতে নজর পড়েছে প্রভাবশালী মাফিয়াদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের সাথে লাগোয়া প্রায় প্রত্যেকটি পাহাড় চূড়ায় গড়ে উঠছে নিত্য নতুন স্থাপনা। অসংখ্য খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছে নতুন নতুন সাইনবোর্ড। পাহাড়ের পাদদেশেও সাঁটানো হচ্ছে ছোট বড় সাইনবোর্ড। অনেকে স্থায়ী সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ করছে। সড়ক নির্মাণের জন্য সিডিএ’র পাহাড় কাটার সুযোগে অনেক প্রভাবশালীও ইতোমধ্যে সাবাড় করেছে বড় বড় অনেক পাহাড়। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও নিজের মনের মতো করে পাহাড় কেটে নিজের স্থাপনা বানিয়েছে। যে কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানাও গুণতে হয়েছে তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে নতুন নতুন সাইনবোর্ড টাঙানো নিয়ে পক্ষ বিপক্ষে রেষারেষিতে জড়াচ্ছেন রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক অনেক প্রভাবশালী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এবিএম আবু নোমান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম যান্ত্রিক শহরে রূপ নিয়েছে। এখন বায়েজিদ- ফৌজদারহাট লিংক রোডটি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে হওয়ায় এক ধরণের নান্দনিক রূপ নিয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সড়কটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দূরত্ব কমিয়েছে। এতে যানজটও কম হবে। কিন্তু নান্দনিক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় এটার সৌন্দর্য বিনষ্ট করতে অনেকটা ব্যবসায়িক চিন্তা মাথায় এসেছে অনেকের। প্রতিদিন শত শত লোকজন যাচ্ছে, বিশেষত বন্ধের দিনে অনেক লোকজন পাহাড়ের সৌন্দর্য অবলোকন করতে যান।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের এই অধ্যাপক বলেন, ‘পাহাড়তো ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অনেকে এখন পাহাড়গুলোতে সাইনবোর্ড টাঙাচ্ছে। পাহাড়দখল রোধ যদি করা না যায়, তাহলে পাহাড়গুলো বেদখল হয়ে যাবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এ পাহাড় সমতল ভূমি বানিয়ে সেখানে একদিন বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশের কিছু মানুষ এগুলোর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এখন থেকেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি শুরু করা উচিত।’
তিনি বলেন, এখন সবুজ পাহাড়গুলোতে অবৈধ সাইনবোর্ড ঝুলানোর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা উচিত, সাইনবোর্ড সাঁটানো ব্যক্তিদের শোকজ করা উচিত, এগুলো সরানো উচিত এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যদি তা না হয়, পাহাড়গুলো নষ্ট হবে, ভবিষ্যতে এখানে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা তৈরি হবে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমরা পাহাড়ের মালিক নই। তবে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করি। এখানকার পাহাড়ে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা তৈরি হলে, কিংবা পাহাড় কাটা হলে জড়িতের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’