বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৯৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা দুইটি নতুন জাহাজের একটি আজ এবং অপরটি আগামী ডিসেম্বরেই বহরে যুক্ত হচ্ছে। জাহাজ দুইটির নাম দেয়া হয়েছে ‘এমবি বাংলার প্রগতি’ ও ‘বাংলার নবযাত্রা’। এ দুটি জাহাজ থেকে বছরে ৩০০ কোটি টাকা আয় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। চীনে নির্মিত জাহাজ দুটির সাপ্লাইয়ার আমেরিকান কোম্পানি হেলনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস। আগামী পাঁচ বছরে বিএসসি ১৪ জাহাজের একটি সমৃদ্ধ বহর গড়ে তোলারও পরিকল্পনা রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করা বিএসসি দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালের ১০ জুন ‘এমভি বাংলার দূত’ নামে একটি জাহাজ দিয়ে সংস্থার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিভিন্ন সময় এই সংস্থার বহরে যুক্ত হয় ৪৪টি জাহাজ। কিন্তু নানামুখী অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় বিএসসি লোকসান দিতে দিতে একেবারে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়। এক সময় এমন কথাও সংস্থায় প্রচলিত ছিল যে, জাহাজ বিক্রি করে সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতার যোগান দিতে হয়। বয়সের কারণে একের পর এক স্ক্র্যাপ হওয়া জাহাজ বিক্রি করতে করতে ২০১৮ সালে সংস্থার বহরে জাহাজের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র দুইটি। এরপর চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএসসির বহরে ছয়টি জাহাজ কেনা হয়। পুরানো দুইটির সাথে ২০১৮ সালে তিনটি এবং ২০১৯ সালে তিনটি মিলে বিএসসির বহর উন্নীত হয় ৮টি জাহাজে। ২০২২ সালের ২ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালে বিএসসির বহর আবার ৭টি জাহাজে নেমে আসে। পরবর্তীতে গেলো বছরের অক্টোবরে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩৭ বছরের পুরনো ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ ও ‘এমটি বাংলার জ্যোতি’ জাহাজ দুটি অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুইটি জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে পরবর্তীতে ৫৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়া হলে বিএসসিতে জাহাজের বহর নেমে আসে মাত্র ৫টিতে। সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনার রাষ্ট্রায়াত্ত্ব একমাত্র সংস্থার বহরে মাত্র ৫টি জাহাজের ‘কষ্টকর’ অবস্থা থেকে বের হতেই নিজস্ব অর্থায়নে দুইটি নতুন জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসসি।
ইতোমধ্যে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আজ বৃহস্পতিবার চীনের জিংজিয়াং নানিয়াং শিপবিল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে ‘এমভি বাংলার প্রগতি’ জাহাজটি বিএসসি আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নেবে। এরপর আগামী ডিসেম্বরে বুঝে নেবে ‘এমভি বাংলার নবযাত্রা’ জাহাজটি। এর আগে আমেরিকান কোম্পানি হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি থেকে বিএসসি জাহাজটির প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র লন্ডনে বুঝে নিয়েছে।
১৯৯ মিটার লম্বা, ৩৩ মিটার প্রস্থ, ১৮ মিটার ড্রাফটের এমভি বাংলার প্রগতি জাহাজটি ৬৫ হাজার টন পণ্য পরিবহনে সক্ষম। জাহাজটির প্রধান ইঞ্জিন ম্যান–বিএন্ডডাব্লিউ (জার্মান লাইসেন্সের অধীনে নির্মিত, চীন সংযোজিত)। এটির পাম্প স্পেনের এবং কমেপ্রসার নরওয়ের। ইতোমধ্যে জাহাজটির ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়েছে। জাহাজটি চীন থেকে পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ হিসেবে বিশ্বের কোন না কোন বন্দরে যাত্রা করবে। ইতোমধ্যে জাহাজটি দৈনিক ২০ হাজার ডলারের ভাড়াও নিশ্চিত হয়েছে।
বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি জাহাজ থেকে নিট মুনাফা আমরা ১ বছরে আশা করছি ১৫০ কোটি টাকা হবে। ‘এমভি বাংলার প্রগতি’ জাহাজটি প্রথম ৬ মাসের জন্য ভাড়া দিচ্ছি প্রতিদিন ২০ হাজার ডলার করে। এ দুটি জাহাজই বিএসসির বহরের সবচেয়ে বড়, আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও ব্যয় সাশ্রয়ী জাহাজ বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, বিএসসি নিজস্ব অর্থায়নে ৫৫ থেকে ৬৬ হাজার ডিডব্লিউটি ক্ষমতাসম্পন্ন বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ সংগ্রহের লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির অনুমোদন লাভ করে। পরবর্তীতে নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুন থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদকালে বাস্তবায়নের জন্য গত ৩ জুন ডিপিপি অনুমোদন করে। এরই প্রেক্ষিতে ৪ জুন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বিএসসি ও সরবরাহকারী বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
চুক্তি মোতাবেক প্রতিটি জাহাজের মূল্য ৩৮ দশমিক ৩৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দুটি জাহাজের মোট সমন্বয়কৃত ও সুপারিশকৃত মূল্য ৭৬ দশমিক ৬৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাহাজ দুইটি নির্মিত হয়েছে চীনে। নির্মাণকালে বিএসসির বিশেষজ্ঞ টিম নির্মাণ কার্যক্রম পরিদর্শন করে। জাহাজের স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত এবং কারিগরি মূল্যায়নে ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির প্রতিনিধির বিশেষজ্ঞ সেবা নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন প্রাপ্তির পর জাহাজগুলোর নাম পরিবর্তন করে এঙসিএল জিমিনিকে ‘এমভি বাংলার প্রগতি’ এবং এঙসিএল লায়নকে ‘এমভি বাংলার নবযাত্রা’ করা হয়। জাহাজ দুইটি গ্রিন শিপ কনসেপ্টে নির্মিত। এই ধরনের জাহাজ জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানদণ্ডসম্মত। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সংস্থা (আইএমও) নির্ধারিত সর্বশেষ পরিবেশগত মানদণ্ড পূরণ করা জাহাজ দুইটি বিশ্বের যে কোন বন্দরে চলাচলে সক্ষম বলেও বিএসসি সূত্র জানিয়েছে।












