ডাস্টবিনগুলোর বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা আবর্জনা–দুর্গন্ধময় পরিবেশ, পলিথিন–প্লাস্টিকে সয়লাব নগরীর নালা–নর্দমা খাল–নদী, নগরায়নের নামে কেটে ফেলা হচ্ছে অঙিজেন সরবরাহকারী বৃক্ষ, রাতের আধারে কেটে ফেলা হয় পাহাড়, কালো ধেঁাঁয়া ছেড়ে চলাচল করছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, নদীগুলো হয়ে যাচ্ছে দখল এবং পানি হচ্ছে দূষিত, কলকারখানাগুলোর নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, উজাড় হয়ে যাচ্ছে বন, এভাবেই প্রতিনিয়ত আমাদের পরিবেশকে আমরা করছি বিপন্ন। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, ব্যাপকহারে রাসায়নিক ও কীট নাশকের ব্যবহার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জনসংখ্যার আধিক্য, বৈশ্বিক উষ্ণতা সব মিলিয়ে আমরাই নষ্ট করছি আমাদের বেঁচে থাকার পরিবেশ। বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা আবারও প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। এ ধরনের খবর নিশ্চয়ই আমাদের জন্য মোটেই সুখকর নয় বরং তা উদ্বেগের বিষয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে বেশি মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। পরিবেশ ও চিকিৎসাবিদ্যা মতে, বায়ুদূষণ থেকে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) নামে শ্বাসতন্ত্রের যে রোগ হয়, তা বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। শুধু এ রোগেই পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। অতিরিক্ত বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাববিষয়ক চিত্রটি আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। এসডিজির ২৪১টি নির্দেশনার মধ্যে ২৫টিই পরিবেশ সংক্রান্ত অথচ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এসডিজি অর্জনে ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক নয়।
পলিথিন বা প্লাস্টিক এমন একটি পদার্থ যার আয়ুুষ্কাল অফুরন্ত। এটি মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছে তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। সেই একই কারণে পলিথিন বা প্লাস্টিকের বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলে দিলে তা নর্দমায় আটকে গিয়ে পানির প্রবাহে বাধা দেয়। যার ভুক্তভোগী ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর লাখ লাখ মানুষ, একটু বৃষ্টি হলেই জমে যায় পানি। পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্ক এক প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বে পলিথিন এবং প্লাস্টিক দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১০ নম্বরে। পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক পরের দিকে পলিথিন ব্যবহার শুরু, আশির দশকে প্রথম বাজারে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু তা এতটাই বড় বিপর্যয় ডেকে আনে যে, ব্যবহার শুরুর ১৫ থেকে ২০ বছরের মাথায় ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে এর উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহারকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বাংলাদেশে এটি যে নিষিদ্ধ তার বোঝার কোনও উপায় নেই, পলিথিন যে পরিবেশকে ধ্বংস করছে সে কথা কেউ ভাবছে না। আইন করে নিষিদ্ধ করার পরও পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না কারণ সেই আইনের সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। পলিথিন ব্যবহার রোধকল্পে বাংলাদেশে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে ১৭টি পণ্যের সংরক্ষণ ও পরিবহন পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কিন্তু তা অনেকটা কাগজে কলমে আছে।
ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়নে ব্যবহৃত ইটের প্রধান কাঁচামাল হলো মাটি এবং এই ইটভাটাগুলো কৃষিজমির পাশে অবস্থান নিয়ে কৃষিজমির উর্বর মাটি ব্যবহার করে। মাটির উপরিভাগের টপসয়েলের ৬ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরানো হলে তা মাটির উর্বরাশক্তি কমিয়ে দেয়, অথচ ক্ষেত্রবিশেষে ইটভাটাগুলো ২০ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরিয়ে নিচ্ছে, যা আমাদের পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান হুমকি।
একসময় বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের বিস্তার ছিল ১৭ হাজার বর্গ কি. মি. যা এখন ৬ হাজার ৪৬৭ বর্গ কি. মি.। বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে তৈরি করা হয়েছে শিল্পকারখানা। তবে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দেশের মোট আয়তনের ২২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়ে ইতোমধ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের দেশের শিল্প কারখানা তৈরী হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা থাকে না, সেক্ষেত্রে কলকারখানা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি–ঘরের বর্জ্য পানি পরিশোধন করে পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, প্রয়োজন কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা। কৃষি ক্ষেত্রে, গবাদিপশু পালনে, মাছ চাষে অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ রাসায়নিকের ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করা দরকার। একই সাথে কালো ধোঁয়া উদগীরণকারী সমস্ত যানবাহনকে রাস্তায় চলাচলে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা দরকার।
পরিবেশ বিপর্যয় একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। এর প্রতিক্রিয়া বহুমাত্রিক, অনেক ক্ষেত্রে জীবন বিপন্নকারী। অপরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থা, শিল্পায়নে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বনভূমি, পাহাড়, নদী সংরক্ষণ ও নগরায়ণের পরিবেশগত বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করা, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ, অতিবৃষ্টি–অনাবৃষ্টির মতো অবস্থায় পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিবেশ দুর্যোগের কবলে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক গ্রাউন্ডসওয়েল প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীব্যাপী পরিবেশের বিপর্যয় শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে ২০৫০ সাল নাগাদ। এ সময় দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে অভিবাসিত হবে প্রায় ৪ কোটি মানুষ এবং যার অর্ধেকই হবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার ঘনত্ব, জমির বিরূপ ব্যবহার, বাধা ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ন, দ্রুত মরুকরণ প্রক্রিয়া, অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বনাঞ্চল ধ্বংস, জলাধার ভরাট, কয়লা, কাঠ, জীবাশ্ম জ্বালানি এই বিপর্যয়কে আরো দ্রুততা দান করছে। বাংলাদেশে এখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি–অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ও ফসলহানির যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা বিপর্যস্ত পরিবেশের কারণে।
প্রকৃতপক্ষে বায়ু বা অন্যান্য দূষণ কমানোর মাধ্যমে বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কোনও জাদুর কাঠির প্রয়োজন নেই। সকলের আন্তরিক প্রয়াস এবং সবার সহযোগিতা থাকলে অবশ্যই ঐ শহরকে সবচেয়ে ভালোভাবে বসবাস ও সবচেয়ে সুখী শহরের উপযোগী করে তোলাও সম্ভব। অথচ আমরা নিজেদের সচেতনতা বৃদ্ধি না করে শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সরকারকে দোষারোপ করে যাই। এ ব্যাপারে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। আমরা নিজের অজান্তেই নিজেরাই আমাদের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছি। ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচী (ইউনেপ) প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে সে দিবসটি পালন করে। শুধু বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে উপলক্ষ্য করে নয় এই বিশ্বকে পরিবেশবান্ধব করে মানুষের মানবিক–নৈতিক–পরিবেশগত মূল্যবোধ সুরক্ষায় আমরা সবসময় সচেষ্ট থাকবো এই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।