চলচ্চিত্রের সচেতন দর্শকদের কাছে জাঁ পল বেলমন্দো পরিচিত এবং প্রিয় একজন অভিনেতা। বিশ্বজোড়া ডাকসাইটে পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করলেও জাঁ লুক গদারের সিনেমার অভিনেতা হয়েই তিনি একটু বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। ব্রেথলেন্স পিয়েরে লে ফু, আ ওমেন ইজ আ ওমেন গদারের এসব ছবি তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয়।
মোট ৯১টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ডি সিকা, শ্যাব্রল, ত্রুফোসহ ফরাসি দেশের দুঁদে সব পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করেছেন বেলমন্দো। রোমান্টিসিজন এবং ইনটেলেকচুয়ালিটির সংমিশ্রণে দুর্দান্ত এক স্ক্রিন প্রেজেন্স পাওয়া যেত তাঁর অভিনয়ে। গদারের উপরোল্লিখিত তিনটি ছবি এবং ভিত্তোরিয়ো ডি সিকার টু ওমেন এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে বোরসালিনো, দি প্রফেশনাল, প্রিস্ট, ফিয়ার ওভার দি সিটি, আ মেন এন্ড হিজ ড ক্যাসিনো রয়াল (১৯৬৭), দ্যাট ম্যান ফ্রম রিও, লিওঁ মরিঁ, ইজ প্যারিস বার্নিং, দি ম্যান ফ্রম অ্যাকাপুলকো, লা মিজারেবল’ মিসিসিপি মারমেইড’ দি মার্জিনাল, দি সলিটারি, স্তাভিস্কি, হ্যাপি ইস্টার দি বানানা পিল। তবে ফ্রান্সের বাইরে ইতালি, জার্মানি ও হলিউড মিলিয়ে ৯১টি ছবিতে অভিনয় করলেও গদারের ব্রেথলেস ও পিয়েরে লে ফু (পিয়েরে দ্য ম্যাড) বেলমন্দোর প্রতিনিধিত্বকারী ছবি হয়ে থেকে গেছে সবসময়। অথচ ব্রেথলেসের আগে আরো নয়টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন।
তাঁকে বলা হতো নিউওয়েভ আইকন বা নিউওয়েভ আইডল অ্যাকটর। নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশাল অর্জন। নিউওয়েভ চলচ্চিত্র আন্দোলন যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে গিয়েছিল, নবতরঙ্গ, সিনেমা নোভো, নিউ সিনেমা, ডিরেক্ট সিনেমা যা মূলতঃ ইতালির নিও রিয়ালিজন ফিল্ম মুভেমেন্টের বিশ্বজনীন প্রসার, ফ্রান্সে যা ন্যুভেল ভাগ নামে অভিহিত হতো, বিশ্বজুড়ে অনেক নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী এই চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত কিংবা এই আন্দোলনের ফসল হলেও জাঁ পল বেলমন্দোই অভিহিত হয়েছে নিউওয়েভ আইকন বা নিউওয়েভ আইডল হিসেবে। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে।
বেলমন্দো আন্তর্জাতিক অভিনেতা হয়ে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের ছবিতে অভিনয় করেও স্টারডমে বিশ্বাস করতেন না। নিউওয়েভ চলচ্চিত্র আন্দোলনের যেটা প্রধান বৈশিষ্ট্য, স্বল্প বাজেট ও অতি সাধারণ নির্মাণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র তৈরি করা, এই ঘরানায় তিনিও বিশ্বাস করতেন, নিজে কোনো চলচ্চিত্র পরিচালনা না করলেও নিজের প্রযোজনা সংস্থা সেরিটো থেকে যে ২৫টি সিনেমা তিনি প্রযোজনা করেছেন, সেখানে বাজেটের স্বল্পতা না রাখলেও ছবিগুলোর জীবন ঘনিষ্ঠ কাহিনী ও শিল্পনির্ভর গুণাবলীর ওপর জোর দিতেন।
অ্যালাঁ রেনে, লুই মাল, জা লুক গদার, জাঁ পিয়েরে মেলভিল, ফঁ্রাসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শ্যাব্রল, ক্লদ লেলুশ অর্থাৎ ফরাসি ন্যুভেল ভাগ বা নবতরঙ্গের সকল দিকপালের ছবিতে অভিনয় করার গৌরবময় সুযোগ তিনি পেয়েছেন। কথাটি উল্টোভাবে বললে, ফরাসি নিউওয়েভের এসব দিক পাল চলচ্চিত্রকারেরা বেলমন্দোকে পেয়ে তাঁর অভিনয়ের সহায়তায় তাঁদের চিন্তাধারাকে মূর্ত করে তোলার সুযোগ পেয়েছেন, যে কারণে তাঁকে নিউওয়েভ আইকন বলা হয়ে থাকে।
অভিনয় জীবনে আনা কারিনা, ক্যাথরিন দানিউভ, ক্লদিয়া কার্দিনেল, উরসুলা এ্যান্ড্রুস, ইসাবেলা হিউবার্ট, সোফিয়া লোরেনের মতো দুনিয়া কাঁপানো অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে আনা কারিনার সঙ্গেই তাঁর স্ক্রিন কেমিস্ট্রি ছিল সবচেয়ে যুৎসই।
সমাজ বিচ্ছিন্ন বোহেমিয়ান কিংবা অপরাধমূলক চরিত্রে (ব্রেথলেস, পিয়েরে লে ফু) বেশি মানানসই হলেও সব ধরনের চরিত্রে সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন। মারকুটে কিছু বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন। পেশাদারিত্বের কারণে হলেও নিজেকে বিশেষ কোনো ইমেজে আবদ্ধ করে না রাখার কারণেও যে এটা করেছেন সেটা বোঝা যায়। তবে সর্বত্রই তাঁর অভিনয় শৈলির নিজস্বতা ও স্বতস্ফূর্ততার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন যা ‘লে বেলমনদিজমি’ বা ‘দি বেলমন্দোইজম’ নামে খ্যাত হয়ে উঠেছিল।
১৯৫৬ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মলিয়েরে’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ। পরের বছর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অন ফুট, অন হর্স এন্ড অন হুইলস ছবিতে অভিনয় করে তিনি প্রথম নজর কাড়েন। তবে ১৯৬০ সালে জাঁ লুক গদারের ‘ব্রেথলেস’ ই বেলমন্দোকে সিনেমা দুনিয়ায় পরিচিত করে তোলে এবং তাঁর অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
বেলমন্দো প্রথমে চেয়েছিলেন খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে। বক্সিং এ প্রশিক্ষণও নেন স্কুলে পড়ার সময়। পরে আগ্রহ ছুটে যায় নাটকে। ১৯৫৬ সালে ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব ড্রামাটিক আর্টস থেকে স্নাতক হওয়ার নাটকে কিছুদিন কাজও করেন। কিন্তু তাতেও মন না ভরায় ১৯৫৬ সালেই সিনেমায় কাজ করা শুরু করেন এবং খুঁজে পান আসল ঠিকানা। এসব কথা এবং ব্যক্তিজীবনের নানা কথা তিনি অকপটে বলে গেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘থার্টি ইয়ারস এন্ড টোয়েন্টি ফাইভ ফিল্মস’-এ।
ভাস্কর পিতা পল বেলমন্দো ও সংগীতানুরাগী মা সারাহ্ রেনো-রিচার্ডের মধ্যবিত্ত পরিবারে প্যারিসের শহরতলী নিউলিং-সুর-সিনেতে জা পল চার্লস বেলমন্দোর জন্ম ১৯৩৩ সালের ৯ এপ্রিল। ডাক নাম বেবেল। এক পুত্র দুই কন্যার জনক বেলমন্দোর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটলো ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ জন্মশহর প্যারিসে, যে শহরের চলচ্চিত্র তাঁকে পরিণত করেছিল নবতরঙ্গ চলচ্চিত্রের আদর্শ এক প্রতিমূর্তিতে।