নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে নারী নিরাপদ। ঘরে বাইরে সর্বত্র হেনস্থার শিকার এরা। এমন কি শিক্ষাঙ্গনেও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়মিত প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।
পত্রিকাগুলোতে এমন কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এ রকম লজ্জাকর খবর নেই। ‘স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ, বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণ, শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে, নানান প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ’ প্রভৃতি নৈমিত্তিক খবর এখন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী ও শিশু লাঞ্ছনার ঘটনা বেড়ে চলেছে। ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। বিচারহীনতা ধর্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক জরিপে দেখা যায়, অপরাধ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ দায়ের করতে নারী অনিরাপদ বোধ করেন। বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ নারী মনে করেন, অপরাধীকে দোষারোপ না করে বরং নারীকেই দোষারোপ করা হয়। আর ৫৭ শতাংশ নারী মনে করেন অপরাধকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না। এই সংগঠনের আরেকটি জরিপে দেখা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি হয় ঘরোয়া সহিংসতার মাধ্যমে। জরিপে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক দায়েরকৃত মামলায় প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে দু’জনই ঘরোয়া সহিংসতার শিকার।
এটা সত্যি যে, নারীদের ওপর সহিংসতার একটি কারণ হলো– সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারে না বরং পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে সহ্য করতে বাধ্য হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পর বছর নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে আন্দোলন করেও এর সমাধান মিলছে না। অতীতে মানুষের মধ্যে এত সচেতনতা ছিল না। তখন নারী নির্যাতন যে একটা অপরাধ সেটা হয়ত অনেকে জানত না। এখন সময় পাল্টাচ্ছে। শিক্ষা–দীক্ষায় এগিয়েছে মানুষ। সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে সব ক্ষেত্রে। কিন্তু নারী নির্যাতনের মতো একটি মারাত্মক স্পর্শকাতর বিষয়ে তেমন উল্লেখ করার মতো সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। তাঁরা বলেন, নারী সহিংসতা রোধে আইন আছে, আছে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি। কিন্তু এগুলোর তেমন কোনো বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। তাই সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তবে আমাদের সামাজিক মাইন্ড সেট যদি পরিবর্তন করা না যায় তাহলে কেবল আইন দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা যাবে না। প্রশাসনের উদাসীনতায় উচ্চ পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার নারীকে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে আনতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল এ আসা মামলাগুলোকে রেকর্ড রাখতে হবে।এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। কথা বলতে হবে নিজ অধিকার আদায়ে।এ সমস্যা মোকাবিলায় নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়া দরকার। উন্নত আইনব্যবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি বদল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির দিক থেকে পুরুষেরও এগিয়ে আসা দরকার। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের দায়িত্ব শুধু পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশই নয় বরং ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারের মূল দায়িত্বটা পালন করা জরুরি।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের মতে পাঁচটি সেক্টর খুবই গুরুত্বপূর্ণ– প্রথমত সরকারের সব পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সহযোগিতা, দ্বিতীয়ত জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানো, তৃতীয়ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে তথ্য ও সহযোগিতা প্রদান, চতুর্থত সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্তিকরণ যারা সমাজের কথাগুলোকে তুলে ধরেন এবং পঞ্চমত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তির সক্রিয় ভূমিকা পালন।
মনে রাখতে হবে যে, নারীর প্রতি সহিংসতা বহুমাত্রিক এবং এটা মোকাবেলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এরমধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা খুবই জরুরি। আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।