নারীর প্রতি সহিংসতা
দেশে প্রতি ৪ জন নারীর ৩ জনই সহিংসতার শিকার
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস) বলছে বাংলাদেশে প্রতি চারজন নারীর মধ্যে তিনজন জীবনে অন্তত একবার হলেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আরো জানা যায়, ৭৬ শতাংশ নারী কখনো না কখনোও জীবনসঙ্গী বা স্বামীর দ্বারা শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
জীবদ্দশায় স্বামীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৪ শতাংশ নারী। শাশুড়ি কিংবা অন্যান্য লোকের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৮.৩ শতাংশ নারী।
সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে জরিপে উঠে এসেছে যৌতুক প্রথা, স্বামীর মাদকাসক্তি, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ও শহরে বস্তিতে বসবাস সব মিলিয়ে ঝুঁকি বাড়ায়।
আইন–কানুন
সংবিধান, আইন ও সরকারে নারীর প্রতি সমতা
অভিন্ন পারিবারিক আইন তৈরির দীর্ঘ দিনের দাবি রয়েছে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। যে আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে সমান অধিকার থাকবে। তবে সংবিধান সমতার কথা বললেও সমাজে অসমতা থেকে যাচ্ছে। এই অসমতা দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোও পদক্ষেপ নেয়নি। সংবিধান ও আইনে এসব বৈষম্য দূর করতে পরিবর্তন চেয়ে সুপারিশ করতে যাচ্ছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। সম্পদ–সম্পত্তি, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে নারীকে সমান অধিকার দেওয়া, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের নিচে) মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ বন্ধ, সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মতো নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার মতো বড় ধরনের সুপারিশ আসছে।
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে–যেমন ১৯(১), ১৯(৩), ২৮(১) ও ২৮(২)-এ সর্বজনীন নীতির অধীন নারীর সমতা এবং সবক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তবে সংবিধান রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনে সমান অংশগ্রহণের কথা বললেও পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনকেও স্বীকৃতি দেয়। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত এবং উত্তরাধিকার পারিবারিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
চার দশক আগে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সনদ ‘নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ (সিডও)’ অনুমোদন করলেও ২ ও ১৬.১(গ) ধারার ওপর সংরক্ষণ রেখেছে বাংলাদেশ। সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১(গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী–পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য
সন্তান জন্মের পর বিষণ্নতায়
ভোগেন ৭৭ শতাংশ নারী
দেশে নারীদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার পুরুষের তুলনায় বেশি। অন্তসত্ত্বাকালীন ও প্রসবোত্তর সময়ে এ ঝুঁকি বেশি। গর্ভাবস্থায় ও সন্তান জন্মের পর ৭৭ শতাংশ নারী ভোগেন বিষণ্নতা কিংবা উদ্বেগজনিত সমস্যা সংক্রান্ত মানসিক রোগে।
এদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ নারীই উভয় সমস্যার সম্মুখীন হন। সমপ্রতি আইসিডিডিআর, বির অ্যাডসার্চ প্রকল্পের গবেষণায় বাংলাদেশে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, দেশের প্রায় ১৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্করা ভুগছেন বিষণ্নতা, উদ্বেগজনিত রোগ, সোমাটিক সিম্পটম ডিজ–অর্ডার, বাইপোলার ডিজ–অর্ডারসহ নানাবিধ মানসিক রোগে। এর ভেতর শিশু–কিশোর এবং নারীদের হারই বেশি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট এর দাবি, দেশে বর্তমানে মোট সাইকিয়াট্রিস্টের সংখ্যা মাত্র ৩৫০ জন। অর্থাৎ প্রায় প্রতি ছয় লাখ মানুষের বিপরীতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আছেন কেবল একজন। এমন ভয়াবহ চিত্রে, নারীর স্বাস্থ্য হুমকির মুখে বলে মনে করছেন তারা।
সুন্দর মন, সুন্দর পৃথিবী
যে ১০ টি উপায় অবলম্বন করেই যত্ন নিতে পারেন মানসিক স্বাস্থ্যের–
১। নিজের জন্য অন্তত ৩০ মিনিট সময় বের করুন–প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট নিজের জন্য রাখুন। এই সময়টা গান শোনা বা চুপচাপ বসে থাকা– যেকোনো কিছু হতে পারে যা আপনাকে শান্তি দেয়।
২। ‘না’ বলতে শিখুন– সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে না নিয়ে অপ্রয়োজনীয় চাপ থেকে মুক্ত থাকুন। ভদ্রভাবে ‘না’ বলাটাও মানসিক সুস্থতার অংশ।
৩। নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম–হালকা শারীরিক ব্যায়াম, যেমন ইয়োগা বা হাঁটাচলা, মস্তিষ্কে সুখের হরমোন বাড়ায়। পর্যাপ্ত ঘুম মনের ভারসাম্য রক্ষা করে।
৪। মনের কথা শেয়ার করুন–বন্ধু বা পরিবারে নিজের অনুভূতি শেয়ার করুন। একাকীত্ব মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হতে পারে।
৫। ইতিবাচক চিন্তা চর্চা করুন–নেতিবাচক চিন্তার চক্র থেকে বের হয়ে আসতে নিজের ভালো দিকগুলো মনে করুন এবং প্রতিদিন ছোট ছোট সাফল্যকে উদ্যাপন করুন।
৬। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট কৌশল রপ্ত করুন–গভীর শ্বাস নেওয়া, মেডিটেশন, ডায়েরি লেখা বা প্রার্থনা–এসব পদ্ধতি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
৭। প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নিন–যদি দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্নতা বা উদ্বেগে ভোগেন, তাহলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সহায়তা নিতে দ্বিধা করবেন না।
৮। নিজেকে অপরাধবোধে না ভোগানো–সবকিছু নিখুঁত হতে হবে–এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন। ভুল করা মানুষেরই স্বভাব।
৯। সীমারেখা নির্ধারণ করুন–ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মজীবনে নিজের জন্য সুনির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করুন যাতে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট না হয়।
১০। নিজেকে ভালোবাসুন ও মূল্য দিন–প্রতিদিন নিজেকে বলুন, “আমি গুরুত্বপূর্ণ”। নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া মানসিক সুস্থতার মূল।











