মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে এখনই কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন বিখ্যাত ফরাসী বুদ্ধিজীবী বার্নার্ড হেনরি লোভি। এ–বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করা এই দার্শনিক (দৈনিক প্রথম আলো ১৪ মার্চ ২০২০)।
এই গণহত্যার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের অনেক নারী যারা নানাভাবে যুদ্ধকালীন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে নারীর প্রতি যুদ্ধকালীন সহিংসতাকে আইনগত স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে গত দশকের নব্বই–এর দশকে। ১৯৯৫ এর বেইজিং ঘোষণায় এ দাবি প্রথম উত্থাপিত হয়। অত:পর আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) যা ১৯৯৮ সালের রোম সংবিধির ফসল, ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ধর্ষণসহ সব ধরনের যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে স্থান দেয়। বুলেটিন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মার্চ–২০১১।
অতীত থেকে বর্তমান যে কোন যুগে যুদ্ধে বা মানবতার বিরুদ্ধে যে কোন ঘটনায় আক্রান্ত হন নারী ও শিশু। বিশেষত নারীর প্রতি সহিংস আচরণের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক অংশ হিসেবে শত্রুকে অপমানিত করা, যেমন– মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণ, বাগদাদে মোঙ্গল আক্রমণ, ভারতবর্ষে তৈমুরের আক্রমণ, বুন্দেলখন্ডে মুঘল আক্রমণ, নাদির শাহের ভারত আক্রমণ, বাংলায় মারাঠা আক্রমণ, ভারতে আফগান আক্রমণ, ফ্রান্সের আলজেরিয়া দখল, বুলগেরিয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধ, বক্সার বিদ্রোহ, রুশ জাপান যুদ্ধ, নামিবিয়ায় হেরেবো বিদ্রোহ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ, দ্বিতীয় চীন জাপান যুদ্ধ সহ আরো অনেক যুদ্ধে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কত জন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন? আমরা একটি সংখ্যাই বলি ভাঙা রেকর্ডের মতো ‘দুই লক্ষ’। প্রকৃতভাবে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায় এ সংখ্যা হচ্ছে কম করে হলেও পাঁচ লক্ষ।
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে বলছে– ‘এ সংখ্যা কম পক্ষে ৪,৬৮,০০০ জন।’ সুইডেনের উপসালা বিষয়ের একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীর সংখ্যা প্রায় চার লাখ’। অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে এসেছিলেন বাংলাদেশে নিপীড়িত নারীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য। তাঁর তথ্যানুসারে “নির্যাতনে গর্ভধারণ করেছেন প্রায় ২ লক্ষ আর নির্যাতনের শিকার প্রায় ৪ লক্ষ ৩০ হাজার।”
কেন বাঙালি নারীর ওপর, পাকিস্তানিদের আক্রমণ ? প্রথমত বাঙালিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এর সাথে যুক্ত অবশ্যই অপরাধ প্রবৃত্তি। বাঙালিরা পাকিস্তানের কাছে ছিল বিদাতি, মুরতাদি,মুনাফেক ও মুশরিক। দুটি পদ্ধতি ছিল তাদের উপস্থিত শারীরিক নিপীড়ন আরেকটি দীর্ঘদিন ক্যাম্পে বন্দি রেখে নির্যাতন।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিজয়ের আনন্দে যখন জনগণ উদ্বেলিত তখন এই অসহায় নারীরা কেমন ছিলেন? অনেকে তাৎক্ষণিক আত্মহত্যা বা যাদের হত্যা করা হয়েছে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তি মরিয়া বাঁচিল’র মতো পরিস্থিতি হয়েছে। নিষ্কৃতি পেয়েছেন যারা বেঁচে ছিলেন, আছেন ! স্বাধীন বাংলাদেশে ড. নীলিমা ইব্রাহীম, সুফিয়া কামালসহ অনেক মহিয়সী নারী তখন খুঁজছেন তাদের ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষ্যে “ক্যাম্পের অনেক নারী তখন পাক সেনাদের সাথে দেশ ত্যাগে প্রস্তুত” অনেকে নিরুদ্দেশ বা ভারতে পলায়ন এদের অনেকের স্থান পতিতালয়ে। কারণ পরিবার বা সমাজ তাঁদের গ্রহণ করবেনা। এদের মধ্যে অনেকে মানসিক ভারসাম্যও হারান। দু’হাজার সাল পর্যন্ত বাঙালি মানসে মুক্তিযুদ্ধে নারী মানেই নিপীড়িত বা নির্যাতিত নারী ফলশ্রুতিতে নারী মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গ তুলনামূলকভাবে হয়ে গেল নিষ্প্রভ।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরম ভালোবাসা ও মমতায় তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিলেন যার আভিধানিক অর্থ “বীরনারী” কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও ধর্মোম্মাদনাজনিত মনোভাবের কারণে এ–শব্দটি হয়ে গেল তাৎপর্যহীন বরং বীরাঙ্গনা উপাধির কারণে সমাজজীবনের স্রোতধারায় মিশে যাওয়ার পথ হয়ে গেল রুদ্ধ।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এদের পুনর্বাসনে নারী পুনর্বাসন বোর্ড ১৯৭২ সালে এবং ১৯৭৫ সালের ১৭ জানুয়ারি এ বোর্ড ‘নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে পরিণত হলেও সবকিছুর বিলোপ ঘটে গেল আশির দশকে। পরম বেদনায় ও আক্ষেপে বলতে হয় যখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতি বরণ করছে সম্মানে তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধার পরিবারও নির্যাতিতা নারীদের গ্রহণ করেনি। একই সাথে বলতে হয় সাহিত্যের জায়গাতে অনেকে এদের নিয়ে এলেন অন্যভাবে। নিজেই পড়েছি কীভাবে এ অসহায় নারীদের পাক সেনারা ব্যবহার করছে তার বিকৃত বর্ণনা। আর এখনো যুদ্ধস্মৃতি নামে তাদের নিয়ে যে বর্ণনামূলক লেখা লিখছেন অনেকে তা সত্যিই দুঃখজনক। ১৯৯৬ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে ধারাবাহিকভাবে ড. নীলিমা ইব্রাহীমের উপস্থাপনায় ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ প্রচারিত হয়েছিল। অত:পর সুদীর্ঘ ২৮ বছর পরে আত্মপ্রকাশ করলেন একজন সাহসী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। এতোদিন পরে কেন? এ–প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যখন একটা পরিণত বয়স হলো আমি বুঝতে পারলাম এ–বিষয়ে একবিন্দু অপরাধ আমার ছিল না। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে যখন পুরোমাত্রায় আস্থাশীল হলাম নিজের প্রতি তখনই বলার সিদ্ধান্ত নিই এদেশের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে। এর পরে পুরো দেশের প্রেক্ষিতে সামনে এলেন হাতে গোনা কয়েকজন। চট্টগ্রামের মহিয়সী নারী রমা চৌধুরীও সময় নিয়েছেন আরো বেশি। নারী সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেওয়া হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে। বীরের মর্যাদায় সমাহিত হয়েছেন দুজনেই। এ–পর্যন্ত মোট ৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন। মনের দিক থেকে কতোটুকু গ্রহণ করেছে সমাজ। সংশয় জাগে অনেক সময়। উল্লেখ্য পাকিস্তান এখনো যুদ্ধকালীন সময়ে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তবে ২০০২ সালে বাংলাদেশ সফরকালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ এ–নৃশংসতার জন্য দু:খ প্রকাশ করেছেন।
২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িতদের অপরাধ তদন্তের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে। এ বিষয়ে আইরিন খান, একজন মানবাধিকার কর্মী, যুদ্ধকালীন সময়ে যে গণধর্ষণ এবং গণভাবে নারীদের হত্যা করা হয়েছে তার সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তবে যুদ্ধে সহিসংসতার শিকার নারীদের বিষয়টি হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তরুণদেরকে অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২) ১৯৯৫ সালে গীতা সেহগালের “ওয়ার ক্রাইমস ফাইল” নামক প্রামাণ্য চিত্রে, ২০১১ সালে মেহেরজান চলচ্চিত্রে (ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধকে দেখা)। ১৯৯৬ সালে নীলিমা ইব্রাহীমের লেখা আমি বীরাঙ্গনা বলছি গ্রন্থে– অতি সম্প্রতি এ বিষয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সুরমা জাহিদের। যুদ্ধশিশু নিয়ে ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘যুদ্ধশিশু’তে যুদ্ধের এ বিভীষিকাময় বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। নীলিমা ইব্রাহিমের গ্রন্থের একজন রীণা তাঁর আশংকা প্রকাশ করেছেন এভাবে–
“একটি মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষা মৃত্যু পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ বা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সংগীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো।”
আসুন এসব মহিয়সী নারীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মিছিলে সমবেত হই সবাই। আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধকালীন গণহত্যার বিষয়টিও উত্থাপিত হোক।