নারীর ন্যায়বিচারের পথে ‘মধ্যস্থতা’র ফাঁদ

নূর সালসাবিল তমা | শনিবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

গৃহসহিংসতা ও যৌতুকনির্যাতনের মামলা আদালতে নেওয়ার আগে বাধ্যতামূলক ‘মধ্যস্থতা’ বা ‘মেডিয়েশন’ আইন প্রণয়নের পর আইন বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে এই আইনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মূলত ভুক্তভোগী নারীরাই। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও যৌতুকসংক্রান্ত সহিংসতার বিচার প্রক্রিয়ায় নতুন এক জটিলতা যুক্ত হয়েছে। সমপ্রতি জারি হওয়া ‘লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অনুযায়ী, এখন থেকে গৃহসহিংসতা বা যৌতুকনির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে সরাসরি আদালতে মামলা করা যাবে না। ভুক্তভোগীকে প্রথমে যেতে হবে আইনি সহায়তাদানকারী অফিসে, এবং সেখানে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা বা মেডিয়েশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।

আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য হিসেবে সরকার বলছে, এটি জমে থাকা মামলার জট কমাবে ও পারিবারিক সমপ্রীতি বজায় রাখবে। তবে নারী অধিকারকর্মীরা মনে করছেন, এটি বাস্তবে ভুক্তভোগী নারীর ন্যায়বিচার বিলম্বিত ও জটিল করবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০এর ১১ () ধারা অনুযায়ী, যৌতুকের দাবিতে শারীরিক নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার সর্বনিম্ন শাস্তি দুই বছর ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড। নতুন সংশোধনীতে সেই ধারায় সরাসরি মামলা দায়েরের আগে “সমঝোতা চেষ্টা” করার বিধান সংযোজন করা হয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, গৃহসহিংসতার মতো অপরাধে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ভুক্তভোগীদের জন্য বিপদজনক হতে পারে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ফোরামের নির্বাহী পরিচালক জানান, “এই আইনের ফলে নির্যাতনকারী ও ভুক্তভোগীকে একই টেবিলে বসিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, এবং যেখানে স্পষ্টতই ক্ষমতার ভারসাম্য নেই। এটি ন্যায়বিচার নয়, বরং নির্যাতনের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি।”

সামপ্রতিক বছরগুলোতে নারী ও শিশু নির্যাতনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে যৌতুকসংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় দুই হাজারের বেশি। সমালোচকেরা বলছেন, সংশোধনীটি নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন করে আইনি প্রক্রিয়াকে পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থে সুবিধাজনক করে তুলেছে। তাদের মতে, যে আইনের উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত বিচার, সেটিকেই ধীর করে দেওয়া হয়েছে সহানুভূতির আড়ালে। অবশ্য এই দাবীর প্রেক্ষিতে সরকারেক পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, এটি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির অংশ হিসেবে প্রণীত; এতে অপ্রয়োজনীয় মামলা রোধ হবে। কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে নারীবাদী সংগঠনগুলোর দাবী যে, ভুল মামলা রোধের নামে এবারে বরং এসংক্রান্ত সকল মামলাই বিলম্বিত হবে। মেডিয়েশন বা মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় যে উভয় পক্ষ সমান অবস্থানে থেকে আলোচনায় বসছে। কিন্তু বাস্তবে নির্যাতিত নারী সেখানে ক্ষমতাহীন আর নির্যাতনকারী পাচ্ছে আইনি সুযোগে সময়ক্ষেপণের। এটি নিছক প্রশাসনিক সংস্কার নয়, এটি পুরুষতান্ত্রিক চাপ আড়াল করে নারী অধিকারের গতি রোধের কৌশল। অর্থাৎ সরাসরি আইনটির বিরোধিতা না করে ধীরে ধীরে অধিকার প্রয়োগের পথ কঠিন করে তোলা। সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো, এর জন্য উদ্ভূত উদাহরণসমূহ। যদি যৌতুকনির্যাতনের মতো অপরাধেও প্রথমে “মধ্যস্থতা” বাধ্যতামূলক হয়, তবে আগামিতে কি এসিড হামলা শারীরিক নির্যাতনের মামলাও চায়ের টেবিলে মীমাংসা হবে?

এই প্রসঙ্গে আইনজীবীরাও সতর্ক করেছেন, যদি এই প্রক্রিয়া যৌতুকসংক্রান্ত মামলায় কার্যকর হয়, ভবিষ্যতে অন্য সহিংস অপরাধেও একই পদ্ধতি প্রবর্তনের দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। নারী অধিকারকর্মীদের মতে, এই সংশোধনী মূলত একটি ‘আইনি অপেক্ষাকক্ষ’ বা ‘ল রেস্টরুম’, যেখানে সময়ের সাথে সাথে ভুক্তভোগীর সাহস, প্রমাণ ও ক্ষতের চিহ্ন সব মিলিয়ে যাবে, আর টিকে থাকবে কেবল অপরাধীর নিরাপত্তা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধৈর্য ও ত্যাগের পরীক্ষা কঠিন চীবর, এ শিক্ষা সকলের জন্য
পরবর্তী নিবন্ধস্যালি রুনি