প্রতিবারের মতো আজ ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হচ্ছে। ১৮৫৭ সালের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে নারীর জীবনমান উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা শুরু হলেও প্রায় দেড়শত বছরেও নারীর পায়ের শিকল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আমরা নারী মুক্তির কথা বলি কিন্তু তা মানতে চাই না বা সুযোগ সৃষ্টিতে এগিয়ে আসি না। এমনকি নারীর জন্য নারীদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এক হওয়া প্রয়োজন। নারীদের আগে সচেতন হতে হবে আমরা কেমন পরিবেশে নিজেদের দেখতে চাই। নারীর প্রতি নারীর যথার্থ মমত্ববোধ আর একতা ঐক্যতায় নারী সচেতনতা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
যদিও কিছুদিন আগে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন নারী উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের নারীর অগ্রগতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে শতকরা ৫৭ ভাগ নারী কর্মজীবী’। নারী শিক্ষায়, সমাজ পরিবর্তনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছেন। নারীর এই অর্জন সম্ভবপর হয়েছে একমাত্র সংগ্রামী চেতনা, সাহসিকতা ও অধিকার সচেতন নারীসমাজ ও নারীবান্ধব পুরুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।
মানুষ সামাজিক জীব। নারী পুরুষের সমন্বয়ে একটা সুন্দর পরিবার, সমাজ, সমপ্রদায়, জাতি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বসভা নন্দিত হয়। একপক্ষকে পিছিয়ে রেখে অন্যপক্ষ একাকী নান্দনিক সমাজ বিনির্মাণ করা কি আদৌ সম্ভব! মানবসন্তান হিসাবে বুদ্ধিমত্তা ও মনোজগতের অভিন্নতায় নারীরা শত বাধা অতিক্রম করে সকল দুঃসাহসিক পেশায় নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন কি আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন মহাকাশে দশ দিনের মিশনে গিয়ে দীর্ঘ আট মাস সুদক্ষ মিশন শেষে এই মার্চ মাসে উনিশ তারিখ সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর দুই সফর সঙ্গী পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। তাঁদের আগমন নিরাপদ ও সফল হোক এ শুভ প্রত্যাশা করছি। সুযোগ আর যত্ন যদি সমানভাবে করা যায় নারী বা পুরুষ প্রতিটি মানবসন্তান হয়ে ওঠতে পারে যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ।
শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন করে। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী, সভ্য ও মানবিক হওয়ার শিক্ষা দান করে। তাহলে আমাদের যুবসমাজ রাজনীতির পটপরিবর্তনে যৌক্তিক দাবী রাখতে পারে এতে কোনো সংশয় নেই। যে কোনো সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে নারীদের ওপর আক্রমণ, সহিংসতা, আক্রোশ, ধর্ষণ ও হত্যা বেগতিক রূপ ধারণ করে। যদি বলি গত ছয়মাসে মানবধিকার আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে, ২৫০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে তারমধ্যে ধর্ষণের পর ১৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে ৩ জন আত্মহত্যা করেছে আরো ৫৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। আবার পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৬৯ জন নারী তন্মধ্যে ৮৪ জন নারী স্বামী কর্তৃক হত্যা হয়েছে। আরো অনেক ঘটনা পরিবার ও সমাজের মানসম্মান ইজ্জতের কারণে মিডিয়া বা নিউজ থেকে বাদ পড়ে যায়। প্রতিনিয়ত সংবাদের হেডলাইনে নারীর ওপর অমানসিক নির্যাতনের খবরে সচেতন নারী হিসাবে আমি নির্বাক ও বাকরুদ্ধ। এমন অরাজক পরিস্থিতিতে আমাদের কন্যারা কীভাবে শিক্ষা গ্রহণে স্বাধীনভাবে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদভাবে যাতায়াত করবে–এই প্রশ্ন আজ সকল মা, বোনের ও নারী সমাজের! আমরা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়। জন্মসূত্রে আমরা এ দেশের নাগরিক, একজন নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদে পথ চলার স্বাধীনতাটুকু নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আশাকরি যুবসমাজ নারীদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে নারী স্বাধীনতাসহ নারীর মত প্রকাশের অধিকার, নারী জীবনের উন্নয়ন ও নারীর প্রতি কোনো ধরণের অন্যায় আচরণ যেন আর না হয় সেদিকে ইতিবাচক দৃষ্টিপাত দিবে।
নারী কি শুধু একজন মমতাময়ী মা, আদরণীয় বোন, অণুপ্রেরণার সাথী, রোমান্টিক প্রেমিকা বা যুগলবন্দী জীবনের পথচলার সহযাত্রী! নারী সাহসী, তেজস্বী, সৃষ্টিশীল, সংগ্রামী ও অপ্রতিরোধ্য এক চরিত্রের নাম নারী। নারীকে দায়িত্ব প্রদান করলে যে কোনো মূল্যে সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। নারী যেরূপ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সেরূপ কঠিন নিষ্টাবান, সততা ও পরিশ্রমীও। যুগে যুগে বাংলার কালজয়ী লেখকদের সাহিত্যে নানান ঐতিহাসিক চরিত্রে নারীকে বহুরূপে উপস্থাপন করেছেন। নারী স্বাধীনতা, ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, কঠোর পরিশ্রমী ও অপরাজিত এক মানবিক সত্তা। মায়া মমতা, স্নেহ ভালোবাসা, কর্তব্যপরায়ণের এক মায়াবী সত্তা নারী জীবন।
সুন্দর, সার্থক, সফল ও আদর্শিক সংসার, পরিবার ও সমাজ বির্নিমাণে নারীসমাজের অতুলনীয় অবদান। কথায় আছে, ‘রাজা রাজ্য শাসন করেন কিন্তু রাজাকে শাসন করেন রানি’। এমন অনিন্দ্য সুন্দর, মায়াবী সত্তা, দায়িত্ববোধসম্পন্ন, মমতাময়ী মা জাতির কল্যাণে সকলে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করে নারীকে মুক্তচিন্তার বেড়ে উঠার নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। আজকের কন্যা শিশু আগামীকালের গর্বিত মা। তাই সমাজ পরিবর্তনে মা জাতির অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষিত মা শিক্ষিত জাতি গঠনে অসামান্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আসুন নারী সচেতনতা ও নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে নারীপুরুষ উভয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতাসহ নিরপেক্ষ উন্নত মানসিকতার উদ্বুদ্ধ হই।
৮ই মার্চ আন্তজার্তিক নারীদিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটির আবেদন বলিষ্ঠ কণ্ঠে দাবী উঠুক। অন্তত একদিন নারীর অধিকার আদায়ের জন্য নারীদের কল্যাণে, নারীর আত্মসামাজিক উন্নয়নে, নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সাধারণ বা প্রান্তিক নারীদের মধ্যে সভা, সমাবেশ, আলোচনা, বৈঠক ও খোলামেলা আলাপ্ল্ল্ল্ল্লচারিতায় দিনটির ইতিহাস ও তাৎপর্য তুলে ধরা হোক। তাহলেই সম্ভব হবে জাতিসংঘের আন্তজার্তিক নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ের প্রকৃত সার্থকতা– ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন’।
লেখক
প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী, লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র