প্রতিটি সংসদীয় এলাকার জন্য একটি সাধারণ আসনের পাশাপাশি নারীদের জন্য একটি সংরক্ষিত আসন রেখে সংসদে মোট ৬০০ আসন করার সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। উভয় ক্ষেত্রে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার সুপারিশও এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত এ কমিশনের তরফে। কমিশন মনে করছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব।
গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক তাদের সুপারিশ তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন। কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও। খবর বিডিনিউজের।
গত ১৮ নভেম্বর ‘নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে এ কমিশন গঠন করে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন তুলে দেওয়ার পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে সুপারিশগুলো তুলে ধরার সময় ৬০০ আসনের প্রস্তাব করার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন শিরীন পারভীন। তিনি বলেন, অনেকেই যখন শুনেছে আমরা ৬০০ আসনের প্রস্তাব করছি, অনেকেই বলেছেন বর্তমান সংসদ ভবনের মূল কক্ষ সেখানে নাকি ৬০০টি চেয়ার বসানো যাবে না। আমরা মনে করি সেটা কোনো কারণ না। জনসংখ্যার কথা যদি আমরা ভাবি, এই জনসংখ্যার জন্য এখন আর ৩০০ আসন মোটেই পর্যাপ্ত না। সুতরাং ৬০০ আসনের যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। দরকার হলে ফোল্ডিং চেয়ার বসানো হবে। কিন্তু ৬০০ আসনের ব্যাপারটা আমাদের কাছে উদ্ভট না। কিন্তু অনেকে বলেছে, আপনাদের এটা উদ্ভট। আলোচনা হোক বিতর্ক হোক, দেখা যাক কী কী যুক্তি আসে। আমাদের যুক্তি হলো, এই জনসংখ্যায় ৬০০ আসন খুব বেশি না। আমরা যদি সত্যি সত্যি চাই নারীরা আইনসভায় বসুক, আইন প্রণয়ন করুক, তাহলে আমাদেরকে এটা মেনে নিতে হবে। আমরা মনে করি এটা একটা সুষ্ঠু ও ভালো প্রক্রিয়া তৈরি করবে রাজনীতির ক্ষেত্রে।
কিছু সুপারিশ দ্রুত কার্যকরের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার : নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো দ্রুত কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের সদস্যরা প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে এ নির্দেশ দেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, যেই সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সেটা যেন আমাদের মাধ্যমে হয়ে যায়। আমরা যেন এই কাজের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি। পৃথিবীর মেয়েরা এটার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা এটা নিয়ে পর্যালোচনা করবে। অনুপ্রাণিত হবে। অন্য দেশের নারীরাও এটা নিয়ে সিরিয়াস।
তিনি বলেন, এটা শুধু নারীদের বিষয় নয়, সার্বিক বিষয়। এই প্রতিবেদন ছাপিয়ে বিলি করা হবে। এটা পাঠ্যবইয়ের মতো বই আকারে ছাপা হবে। দলিল হিসেবে অফিসে রেখে দিলে হবে না, মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। তিনি বলেন, কমিশনের সুপারিশগুলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও উপস্থাপন করা হবে।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, জুলাইয়ে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মরণার্থে এমন কিছু করতে চেয়েছি, যা মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে, সমাজের জন্য কল্যাণকর হবে। তিনি বলেন, কমিশনের সুপারিশগুলো তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিছু সুপারিশ বর্তমান সরকারই বাস্তবায়ন করতে পারবে, কিছু থাকবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য, আর কিছু অংশে তুলে ধরা হয়েছে নারী আন্দোলনের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কমিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদনটি তুলে দেন। কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন মোট ১৫টি বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রতিবেদন হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শিরীন হকের নেতৃত্বে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা। গত বছর ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের উত্তরণের লক্ষ্যের কথা জানায়। সে লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সরকার, যার ধারাবাহিকতায় গত অক্টোবরে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এরপর নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে আরও পাঁচ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
নারীর জন্য সমতা ও সুরক্ষার সুপারিশ : কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ কমিশন নিয়মিত বৈঠক করে ৪৩টি। পাশাপাশি নারী অধিকারকর্মী, উন্নয়ন সংস্থা, শ্রমিক সংগঠন, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে ৩৯টি পরামর্শ সভা হয়। অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সঙ্গে ৯টি যৌথ সভাও হয়েছে তাদের। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, শ্রীমঙ্গল, রংপুর ও ময়মনসিংহে এসব সভা হয়। কমিশন বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ও সংগঠনের পরামর্শও নিয়েছে।
কমিশন তাদের প্রতিবেদনে নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নকে গুরুত্ব দিতে বলেছে। সহিংসতামুক্ত সমাজ গঠনে নারী ও মেয়ে শিশুর সুরক্ষা, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জনপরিসরে নারীর অংশগ্রহণ এবং জনপ্রশাসনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ানোর কথাও এসেছে প্রতিবেদনে। এছাড়া শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, সব বয়সী নারীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ, অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা, শ্রম ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পদক্ষেপ এবং নারী শ্রমিকদের নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার প্রস্তাব এসেছে।
দারিদ্র্য কমাতে টেকসই সামাজিক সুরক্ষা, গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ ও ইতিবাচক চিত্রায়ণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি এবং দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নারীর অংশগ্রহণও কমিশনের সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত। এসব সুপারিশ প্রস্তুতের সময় সংবিধান ও আইন, বিদ্যমান নীতি, প্রতিষ্ঠান এবং কর্মসূচিগুলোকে বিবেচনায় নিয়েছে কমিশন।