নারীদের যাবতীয় অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে

ববি বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ৮ মার্চ, ২০২২ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নারী অধিকার মানবাধিকার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। মানবাধিকারের সব বিষয়গুলোই নারী অধিকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অধিকন্তু নারীদের জন্য আছে কিছু অধিকার, যা একান্তভাবে নারীকে তার নিজস্ব মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে শেখায়।
আর নারীর অধিকার রক্ষায় নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। ক্ষমতায়ন বলতে সাধারণত সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতা, অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। নারীর ক্ষমতায়নকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায়, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূলধারায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। এর পূর্ণ ব্যাখ্যায় বলা যায়: সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন, অভিক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ এবং সমতার ভিত্তিতে সুফল ভোগে নারীর পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সামাজিক ক্ষমতায়ন বলতে নারীর অধিকার ভোগের বিষয়টি প্রথমে আসে। সমাজে নারী কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে এবং সেই ভূমিকা পালনে তার ক্ষমতার চর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই বিষয়টিকে বোঝায়। রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হলো রাজনীতি চর্চায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। এর পূর্ণ ব্যাখ্যায় বলা যায়: ভোট প্রদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক দলে সমতার জায়গা অর্জনে কতটুকু নিশ্চিত তা। এসব জায়গায় নারী, বৈষম্যের শিকার বলে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন একই অর্থে ব্যবহার করা যায় না। সেজন্য ক্ষমতায়নের ধারণা পুরুষের জন্য একরকম, নারীর জন্য অন্যরকম, নারীর ক্ষমতায়ন সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রধান দিক।
নারীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস থেকে যতখানি জানা যায়, ১৬৬২ সালে ওলন্দাজ নারী মার্গারাটে লুকাস রচিত ‘নারী ভাষণ’ হলো প্রথম নারীবাদী সাহিত্য যেখানে নারীর সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছিল। ১৭৮৯ সালে মহান ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণী সারাবিশ্বেও নারীবাদীদের কাছে অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। সেই সময় ‘মানুষের অধিকার’-এর ঘোষণা দানের সময় মহান নারীবাদী ওলানদ্যা, গুৎজা প্রশ্ন উপস্থাপন করেন, ‘নারীদের যদি ফাঁসির কাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে তবে পার্লমেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন? ফরাসি সরকার পরে এই মহান নারীবাদীকে সত্যি সত্যি ফাঁসি দেন। নারীবাদকে প্রথম সংগঠিতরূপে উপস্থিত করেন ইংল্যান্ডের মেরি ওলস্টোনক্রাফট তাঁর বিখ্যাত সাড়া জাগানো নারীবাদী গ্রন্থ ‘নারীর অধিকারের ন্যায্যতা’ গ্রন্থে, ১৭৯২ সালে। এই গ্রন্থের মূল বক্তব্য হলো, নারীরা কোনো ভোগের সামগ্রী নয় বা যৌনজীব নয়, তারাও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাই তাদের স্বাধিকার দিতে হবে।
এই আগুনের স্ফুলিঙ্গ ফুলে ফেঁপে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শিল্পোন্নত দেশসমূহে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে শ্রম আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ে। ফলে ভোটাধিকার আন্দোলনে সকল নারী যোগ দেন। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার শিকাগো শহরে নারী শ্রমিকদের জঙ্গি মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আর্ন্তজাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
পশ্চিমা বিশ্বে নারী অধিকারের আন্দোলনের দানা বেধেঁছিল শিল্পবিপ্লবের পর নতুন সমাজের দাবিতে। আমাদের দেশে এ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এর একশ বছর পর। তখনকার এ সমাজ চেতনাকে আমরা দু’ভাবে দেখতে পারি। সমাজ-সচেতনতা ও রাজনৈতিক চেতনা। তাদের কেউ কেউ মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। আবার কেউ বৃটিশ শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিজেদের যুক্ত করেছেন। পরবর্তী সময়ে স্বর্ণকুমারী দেবী, কাদম্বরী দেবী, পন্ডিত রমাবাঈ, কৃষ্ণভামিনী দাস, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ নারী ব্যক্তিত্ব সমস্যার পর সমস্যার পাহাড় ডিঙিয়ে এগোতে থাকেন। আর বীর নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বের কথা আমাদের সবার কম-বেশি জানা। তিনি সূর্যসেনের সাথে চট্টগ্রামে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে অংশ নেন। পুলিশে ধরা পড়ার সাথে সাথে নিজের কাছে রাখা সায়ানাইড খেয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন।
আবার ’৪৭ পরবর্তী সময়ে বাংলার নারী জাগরণের সূচনায় যাঁদের অনবদ্য অবদান সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতে হয়। তাঁরা হলেন সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগম প্রমুখ। উল্লেখ্য, তাঁরা সম-অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের বিশাল ক্ষেত্র উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বনেতৃবর্গের মধ্যে জোয়ান অভ আর্ক, অ্যানা ফ্রাঙ্ক, রাণী ভিক্টোরিয়া, ইন্দিরা গান্দী, মাদার তেরেসা, মার্গারেট থ্যাচার সহ আরো অনেকের কথা বলা যায়। মহাত্মা গান্ধী তাঁর সব বক্তৃতায় নারীদের অধিকারের কথা বলেছেন।
তেমনি সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীর অগ্রযাত্রাকে স্থায়ী রূপ দিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা অন্তর্ভুক্ত করেন, নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে শিক্ষায় নারীদের শতভাগ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করাসহ রাজনীতিতে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ প্রদান করে আসছেন।

আর এর ধারাবাহিতায় প্রথম নারী উপাচার্য, প্রথম নারী পর্বতারোহী, বিজিএমইএ প্রথম নারী সভাপতি, প্রথম মেজর, প্রথম নারী স্পিকার, প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিগত এক দশকে সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যথাযোগ্য অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিও গ্রহণ করেছেন।
সমপ্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নারী নেতাদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বেশ আত্মবিশ্বাসী ও গর্বিত কন্ঠে বলেছেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে ৭ম অবস্থানে আছে।
এটাও ঠিক যে, পরিসংখ্যানের চিত্র দেখলে বাংলাদেশের নারীরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে সংরক্ষিত আসন ও নির্বাচিত ২২ জনসহ ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিও আছেন ১২ হাজার জনের মতো।
কিন্তু এসবই মুদ্রার এক পিঠের ছবি। মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে নারীর প্রতি চরম অবহেলা, সীমাহীন বৈষম্য ও ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে এখনো দেশে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমাজে এখনো নারী পুরুষ মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও ক্রমবর্ধমান। এখনো পথে ঘাটে, গণপরিবহনে, অফিসে, গৃহে নারীরা নিরাপত্তাহীন। সমাজে বহুযুগের পুরনো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো প্রবল দাপটে রাজত্ব করে চলছে। যার ফলে পারিবারিক সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ এবং যৌন হয়রানির মত ঘটনা বাড়ছে। নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকায়, নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে কন্যা-শিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
তাই শুধুমাত্র উচ্চ পদে আসীন নারীদের দেখেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সাথে সাথে নারী অধিকার রক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন আইন ও তার সঠিক বাস্তবায়নের দৃষ্টি দিতে হবে। নারীশিক্ষা ও নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। নারীকে তার কাজের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নে নারীকেই সবার প্রথম এগিয়ে আসতে হবে। নিজেরা সচেতন না হলে, নিজের উন্নয়ন নিজে না ভাবলে ক্ষমতায়ন অসম্ভব। তাই নারীদের যাবতীয় অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, ওমরগণি এমইএস কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধনারী দিবস- একান্ত ভাবনায়