চট্টগ্রামের নারী ক্রীড়াবিদদের অনেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে দেশকে আলোকিত করেছেন। সৈয়দা সাদিয়া জাহান তো শুটিংয়ে কমনওয়েলথ গেমস থেকে পদক নিয়ে এসেছেন। শর্মিষ্টা চাকমা, মরহুম আজিজা চৌধুরীরা জাতীয় পর্যায়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন অ্যাথলেটিক্সে। ফুটবল, ব্যাডমিন্ট কিংবা দাবায় চট্টগ্রামের অনেক নারী দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাই বলে হকি? পুরুষ হকি দল যেখানে খাবি খাচ্ছে সেখানে নারী হকি দল তো কল্পনাই করা যায় না। তবে চট্টগ্রামের দুই কিশোরী স্বপ্ন দেখছে দেশের নারী হকির টুইন টাওয়ার হতে। এ দুজন আবার টুইন (যমজ)। তাদের বয়সের ব্যবধান মাত্র ২ মিনিটের। কিন্তু জুটি বেঁধে পৃথিবীতে আসার মত জুটি বেঁধেই চলছে তাদের সবকিছু। এ দুজন হল হিমাদ্রি বড়ুয়া সুখ আর নীলাদ্রি বড়ুয়া নীল। রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখীল গ্রামের বিজয় বড়ুয়া বাপ্পা এবং রায়না বড়ুয়া নিপার ঘর আলো করে যেদিন এই কন্যা আসে সেদিন হয়তো খুশিতে বাপ্পা দুই মেয়ের নাম রেখেছিলেন সুখ আর নীল। এই দুই মেয়ে এখন বাপ্পা–নিপার সুখের নীল আকাশ।
এইতো মাত্র কয় বছর আগের কথা। বাবা বাপ্পা মেয়েদের নিয়ে আসেন এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ক্রিকেট শেখানোর জন্য। চট্টগ্রামের অতি পরিচিত ক্রিকেট প্রশিক্ষক তপন দত্তের জুনিয়র ক্রিকেট ট্রেনিং একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন দুজনকে। অনুশীলনও করেন। তার আগে অবশ্য চট্টগ্রামের আরেক কোচ যিনি ছেলে–মেয়েদের হকি শেখাতেন সেই মহসিনের হাতে কিছুদিন হকি অনুশীলন করেন দুবোন। ২০২০ সালে দুজন বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। এরপর ভর্তি হয়ে যায় দেশের ক্রীড়াবিদ তৈরির এই কারখানায়। তখন তাদের কোচ বললেন, দুই বোনকে হকি খেলতে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল দুই বোনের ক্যারিয়ার। বিকেএসপিতে সবগুলো ইভেন্ট থাকলেও নারী হকি দলটি শুরু হয় সুখ–নীলদের নিয়ে। সেদিক থেকে রেকর্ড গড়া চট্টগ্রামের এই দুই কিশোরী সম্প্রতি গায়ে জড়িয়েছেন জাতীয় দলের জার্সি। শুধু জার্সিই জড়ায়নি। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব–১৭ এশিয়া কাপ নারী হকি কোয়ালিফায়ারে রানার্স আপ হয়ে এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করেছে। চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে চায়নাতে। এই অর্জন বাংলাদেশের নারী হকির ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড।
২০২০ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হলেও সে বছরই শুরু হয় করোনা। কিন্তু থেমে থাকেনি সুখ–নীলের হকি স্টিকের কাজ। ২০২১ সালে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক কোনো হকি ম্যাচ খেলতে নামে দুই বোন। পাঁচ ম্যাচের এক হকি সিরিজে স্টিক হাতে মাঠে নামে সুখ–নীল। বাংলাদেশের দুই প্রয়াত হকি সংগঠক মাহমুদ উর রহমান ও শামসুল বারীর নামে দুটি দল গঠন করে এই সিরিজের আয়োজন করা হয়। যেখানে সুখ এবং নীল খেলে মাহমুদ উর রহমান একাদশের হয়ে। সেই যে শুরু এরপর থেকে ছুটে চলছে দুই বোনের পথ চলা।
দলে দুই বোনের দায়িত্বটা আসলে টুইন টাওয়ারের মতই। একে অপরের পরিপূরক। যারা রক্ষণের কাজ করে। হিমাদ্রি বড়ুয়া সুখ গোলরক্ষক আর নীলাদ্রি বড়ুয়া নীল ডিফেন্ডার। দুই জুটি বেধে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকানোর কাজটি করেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। দুই বোন জানালেন তাদের বাবাই তাদের খেলাধুলা, পড়ালেখা সর্বক্ষেত্রে সবচাইতে বড় অনুপ্রেরণা। আর বাবার আশীর্বাদ নিয়েই এগিয়ে যেতে চায় দুইবোন সামনের দিকে।
অতি স্বল্প সময়ে হকিটাকে দারুণভাবে রপ্ত করেছে সুখ–নীল। মাঠে স্টিক হাতে যেমন দুর্দান্ত তেমনি বই, খাতা, কলমেও যেন আরো ক্ষুরধার। এবছর এসএসসি পরীক্ষায় দুই বোন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ নিয়ে পাস করেছে। তাইতো আনন্দের যেন শেষ নেই বিজয় বড়ুয়া বাপ্পার। যদিও পাড়া প্রতিবেশীর টিপ্পনী কম শুনতে হয়নি বিজয় বড়ুয়া এবং তার মেয়েদের। তবে সে সব যেন হকির স্টিক দিয়েই এক শটে উড়িয়ে দিয়েছে। দুবোন তাই বলে, কে কি বলল তা শুনতে আমাদের বয়েই গেছে। আমাদের যাত্রা কেবলই শুরু। আমরা অনেক দূর যেতে চাই। আকাশ ছুঁতে চাই। কেবল অনূর্ধ্ব–১৭ জাতীয় দল দিয়ে শুরু হলো। এখনো অনেক পথ বাকি। মূল জাতীয় দলে খেলতে হবে।
বাবা বিজয় বড়ুয়া চান তার মেয়েরা দেশের হয়ে দীর্ঘদিন খেলুক। মাত্র কদিন আগে অনূর্ধ্ব–১৭ এশিয়া কাপ হকি বাছাই পর্বে রানার্স হয়ে দেশে ফেরার পর এখন চট্টগ্রামেই আছে সুখ আর নীল। শহরে আর তাদের পৈত্রিক নিবাস রাউজানে সবাই এখন তাদের প্রশংসায় ভাসাচ্ছে। যা দুই টুইনের এগিয়ে যাওয়ার পথে অনেক বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছে সুখ আর নীল। বিজয় বড়ুয়ার আরো একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তার নাম অতীদ্রি বড়ুয়া নিসু। সে কেবল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। এই তিন কন্যাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন বিজয় বড়ুয়া। তার আশা তার দুই কন্যা দেশের জন্য অনেক সুনাম বয়ে আনবে। নারী হকিতে সত্যিকারের টুইন টাওয়ার হয়ে উঠকে সুখ–নীল টুইন।