নারীর অগ্রযাত্রার পাশাপাশি নারী নির্যাতনও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। যতই দিন যাচ্ছে, নারীর প্রতি সহিংসতা যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী এগিয়ে যাচ্ছে এটি যেমন সত্য, আবার নারী নির্যাতন বেড়েছে সেটিও অস্বীকার করার উপায় নেই।
ধর্ষণের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে দেশে বিদ্যমান আইন সংশোধন করার দাবি ওঠে। নারী নির্যাতন তথা নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনও পাস হয়। এই আইন মূল উদ্দেশ্য পূরণে কতখানি সক্ষম হয়েছে, এর মাধ্যমে নারী ও শিশুরাই বা কতটুকু প্রতিকার পেয়েছে, সেসব বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেনি। যে কারণে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২১ সালকে বলেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর।
আমাদের দেশে কোনো অপরাধের ঘটনা বেশি ঘটলে বা এ নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হলে আইন প্রণয়ন নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। বিষয়টি যেন এ রকম যে আইনের অভাবেই এত দিন অপরাধটি হয়ে আসছিল বা আইন না থাকার ফলেই অপরাধীদের শাস্তি দেয়া যাচ্ছিল না। তবে বাস্তবে দেখা যায়, প্রায় সব বিষয়েই আমাদের আইন রয়েছে। যুগের প্রয়োজনে কিছু কিছু নতুন আইন করা প্রয়োজন হলেও নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনের জন্য নতুন করে আইনের প্রয়োজন নেই। নারী নির্যাতনের প্রধান কারণ বিচার না হওয়া। যত দিন পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হবে তত দিন এ নির্যাতন চলতেই থাকবে।
আবার আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিশ্লেষকের পর্যবেক্ষণ হলো, এ আইনে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বিচার–প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে না। দায়িত্ব, জবাবদিহি, কৌশল ইত্যাদি আইনে সঠিকভাবে বলা নেই। ধর্ষণ, অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের সঠিক নির্দেশনা নেই। আরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এসব দূর করে আইনটিকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে। তাঁরা বলছেন, এ আইনে আছে মামলা শুরু হলে একবারে শেষ করতে হবে। দেশে যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার হয়, এর প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। সিলেটের রাজন ও খুলনার রাকিবের ক্ষেত্রে দেখেছি কত দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার হয়েছে। অর্থাৎ ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। এ আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা শেষ করতে হবে। কিন্তু শেষ করতে না পারলে কী হবে, সে সম্পর্কে কিছু বলা নেই। তদন্তের ক্ষেত্রে বলা আছে, আসামিকে ধরা হলে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে হবে। আর আসামি ধরা না পড়লে প্রথমে ৬০ দিন, তারপর ১৫ দিন। এরপরও ধরা না পড়লে আদালতের অনুমতি নিয়ে প্রথম পর্যায়ে ৭ দিন, এর মধ্যেও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে না পারলে আরও ১৫ দিন। তারপরও যদি তদন্ত প্রতিবেদন দিতে না পারে, তাহলে তদন্তে গাফিলতির জন্য ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাটা এখনো আমরা দেখতে পাইনি। দিন দিন নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়ে চলেছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা আপসযোগ্য নয়। কিন্তু আপস হচ্ছে। যেকোনো কারণেই স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ হতে পারে। সব ক্ষেত্রেই মামলা করতে হবে, একথা ঠিক না। মামলার বাইরে সামাজিক ও পারিবারিক সহায়তায় কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
আরেকটা বিষয় দেখা যায়, বাদী–বিবাদী প্রায় সময়ই অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে মামলাকে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। ঘটনা যা সেটা দিয়েই মামলা দায়ের করা উচিত। মামলার ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। একটা মেয়ে কখন মামলা করতে আসে, যখন তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তাই যেকোনোভাবেই হোক না কেন আইনি সহায়তা প্রদান করতে চেষ্টা করতে হবে, যাতে ভুক্তভোগী নারীকে কিছুটা সহায়তা করা যায়। সংসারে নারীর অবদানকে মূল্য দিয়ে দাম্পত্য জীবনে অর্জিত সম্পত্তিতে নারীর অধিকার দিতে হবে।
বর্তমান সরকার অত্যন্ত নারীবান্ধব। নারীদের সুরক্ষার জন্য আইন ও নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। আরও অনেকভাবে সরকার এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। তাদের কথা গুরুত্বের সঙ্গে না ভেবে সামনে এগোনো যাবে না। নারী–পুরুষ সবাই সমান। তা বিবেচনা করে আগামী দিনে কীভাবে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে একটি দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
অস্বীকার করা যাবে না যে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় আমাদের অনেক ভালো আইন আছে। এখন আইনগুলোর প্রয়োগের জায়গায় জোর দেওয়াটা জরুরি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন দরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা হচ্ছে, আইনসমূহ কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে তদারক করা প্রয়োজন। নারী নির্যাতন মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না, তাও তদারক করা ও জবাবদিহির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীরা এখন সব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে নারীর জয় বিশ্বজয়।