নারী কৃষকদের স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ১২ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ

কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাত ” এটি বিখ্যাত খনার বচন। খনার বচনে কলা গাছ কাটা, রোপণ এবং গাছ কাটার সময় যাতে মাটির উর্বরা শক্তি বিঘ্নিত না হয়, সেদিকেই খেয়াল রাখতে বলা হয়েছিল। খনা এক বিজ্ঞ নারী। তার প্রতিটি বচনেরই রয়েছে যথার্থতা। তিনি কৃষি কাজে নারীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিকর্মে সেই অনাদিকাল থেকেই যুক্ত গ্রামবাংলার নারীরা। নারীর হাত ধরেই কিন্তু কৃষি কাজের ভূমিকা বপন। সেই ভূমিকা এখনো চলমান। সভ্যতার বিকাশকালে পুরুষরা যখন শিকারে যেতো, নারী তখন গেরস্থালি কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। বীজ বপন করে চারা গাছ গজানো দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হতেন। ধান চাষ করতেন, জমি আবাদ করতেন, শাক সবজি ফলাতেন। আমি এমন অনেক কৃষক নারীকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। তাদের শ্রম আর খাটুনি ছিল নিষ্ঠা আর আন্তরিকতায় ভরা। সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে হেঁসেলের যাবতীয় কাজ সেরে কৃষাণী বধূ জমিতে গিয়ে স্বামীর সাথে কাজ করতেন। হালচাষ, ক্ষেতে পানি দেয়া, বীজতলা তৈরি, চারা রোপণ, ধান কাটা, ধান মাড়াই, ধান শুকানো, ধান ঝাড়া সব কাজেই নারীর শ্রম যুক্ত থাকতো। আর ধান কাটার আগেই কত সুন্দর করে বাড়ির উঠোনঘাটা লেপে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে রাখতেন। ঘরে রবিশস্য তোলার আনন্দে বিভোর থাকতেন। এরপর শুরু ধান কাটা। সেখানেও ভীষণ নিয়ম কানুন আর শৃঙ্খলা থাকতো। কত মুঠি পাকা ধানের চারা দিয়ে পাড়া মারতেন। গোল করে সাজিয়ে সেই ধানের আঁটিকে সাজাতেন। এরপরে মাড়াই, ঝাড়া চালা,শুকানো মিলিয়ে যেনো এক মহাযজ্ঞ। ধানঝাড়ার এক কৌশল ছিল। ৭/৮ জন নারী গোল করে দুহাতে কুলার বাতাস দিয়ে ধান ঝাড়তেন। কি সুন্দর করে চিটা ধান বাতাসে উড়ে যেতো আর সলিড ধান থেকে যেতো স্তূপে। আমাদের বাড়ির সখিনা, আবেদা আর জরিনাদের এসব কাজ আমি দেখেছি। এরা কৃষিকাজে বিস্তর পারদর্শী ছিল। কি চমৎকার করে মেতে উঠতো নবান্ন উৎসবে। নতুন ধানের সিরনি রাঁধতো। মসজিদে পাঠাতেন, পাড়ায় বিলাতেন। এটি ছিল বিনোদন আর আনন্দেরই অংশ। আমি নিয়মিত গ্রামে যাই। পাশের পাড়ায় সনাতনী আর বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের বাস। দাশ বাড়ির বধূশিল্পী একজন সফল কিষাণী। নিজে গরু পালে। দুধ দোয় নিজে। খড়কুটো, কুরা খইল গরুকে খাওয়ায়। অন্যের জমি বর্গা চাষ করে। রবি শস্য আর শাক সবজি ফলায়। ভাঙ্গাচোরা ঘর, তেমন আসবাব নেই। কিন্তু ঝকঝকে আর পরিপাটি। উঠোনে খড়ের গাদা ( কুইজ্জা), গরু বাছুর দুয়েকটা বাঁধা,গরুর গোবরের ঘ্রাণে একাকার রাস্তা থেকে উঠোন পেরুলেই ঘর অব্দি। ওকে দেখলেই আমার গফুর আর আমিনার কথা মনে পড়ে যায়। ওর ঘরে গেলেই বুঝতে পারি, জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব ও বিষণ্ন। কিন্তু তার চোখে মুখে এই দৈন্যদশার কোনো ছাপ নেই। কি হাসিখুশি আর উচ্ছ্বল মেয়েটি। সারাদিন গায়ে গতরে খেটে বাড়ির যাবতীয় কাজ করার পরও কোনো হতাশা দেখলাম না। দুটি সন্তানকে স্কুলে পাঠায়। লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চায় সে। এই লক্ষ্যেই সে এগুচ্ছে। আশায় আশায় কাটছে দিন। আমি বাড়ি যাবার আগেই তাকে ফোন দেই। সে শাক আনাজ তুলে রাখে। গরুর খাঁটি দুধ দুইয়ে বোতল পুরে রাখে। এখনো গ্রামে আমি কিষাণী বধূর আন্তরিক ও স্বার্থহীন মনোভাবের ছোঁয়া পাই। ওর বাড়ির দু’পাশে পাকা ধানের সোনালী চিত্রণ। গাছপালা, তৃণলতাগুল্মই যেনো তাদের ভূষণ। রাস্তার পাশে বট গাছের গোড়ায় লালসালু মোড়ানো। জানতে চাইলাম এর মাহাত্ম্য কি? উত্তরে জানলাম,ওরা মা লক্ষ্মীর পূজা করে এই বটবৃক্ষের নীচে বসে। আসলেই তো। কবি কি এজন্যই বলেছিলেন “বাণিজ্যে বসেত: লক্ষ্মী’। কৃষাণীদের শ্রমের মূল্যায়নের কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম। সে জায়গায় আবার আসি। অনেকেই জানেন না, নারীর কৃষিকাজে সক্রিয় এই অংশগ্রহণের কথা। বেশিরভাগ মানুষ ভাবেন কৃষিকাজ, তো পুরুষেরই কাজ। নারীরা কিভাবে এই কাজ করবে? কিন্তু দেখা গেছে, কৃষি কাজে বীজ বপন থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত মোট ২১ টি প্রধান কাজের ১৭ টি কাজই নারী করে থাকেন। যেহেতু এই কাজের কোনো পারিশ্রমিক নেই, তাই এই শ্রমশক্তিও মূল্যহীন। নারীর এই কর্মক্ষমতা এবং সক্ষমতাকে সব সময় তার প্রাত্যহিক কাজের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রেখেই এর অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। যেহেতু পারিশ্রমিক নেই, তাই, এই শ্রমের মূল্যও নেই। অথচ আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করলে, দেখা যায়, কি অপরিসীম এর মূল্য। আমরা নারী আর পুরুষের শ্রমে এখনো মজুরি বৈষম্য লক্ষ্য করি। একই শ্রম দিয়েও নারী তার উপযুক্ত আর প্রকৃত মজুরী পায়না। আমাদের দেশের এক বিশাল কৃষি নারী গোষ্ঠী আমাদের অন্নদাত্রী হিসেবে কাজ করছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের গহীন জনপদে। এদের শ্রম আর ঘামের ঘ্রাণ আমাদের প্রধান খাদ্য ভাতে। এসব পরিশ্রমী নারীদের কুর্ণিশ জানাই। আর নারী কৃষকদের শ্রম আর ঘামের সত্যিকারের স্বীকৃতি আর মূল্যায়ন চাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্যক্তিগত পরিক্রমা
পরবর্তী নিবন্ধজুনিয়র ব্লাড ফাউন্ডেশনের ঈদ পুনর্মিলনী