ইসলামের মৌলিক পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে নামাজ। আল্লাহর উপর ঈমান আনার পরেই সর্বপ্রথম যে কাজটি সামনে চলে আসে সেটি হল নামাজ। নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত ইসলামি শরীয়তে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নামাজ মানুষকে শৃঙ্খলাবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ শেখায়। ঈমান যদি হয় তৌহিদের মূল ভিত্তি, তাহলে আমলের মূল ভিত্তি হল নামাজ। একজন ব্যক্তিকে নিয়মানুবর্তীতা শেখায় নামাজ। পানি যেভাবে ময়লাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলে, তেমনি নামাজ মানুষের পাপ–পঙ্কিল মানসিকতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলে। মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে মূল পার্থক্য হল নামাজ।
মুসলিমরা নামাজ পড়ে কিন্তু কাফেররা নামাজ পড়ে না। জান্নাতে যাওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে একটি হল নামাজ, যেমন–আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে জাহান্নামের অধিবাসীরা), তোমাদের আজ কিসে এই আযাবে উপনীত করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজীদের দলে সামিল ছিলাম না, অভাবী ব্যক্তিদের আমরা খাদ্য দিতাম না। সত্যের বিরুদ্ধে যারা অন্যায় অমূলক আলোচনায় উদ্যত হত–আমরা তাদের সাথে যোগ দিতাম, আমরা আখেরাতকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম’–সূরা–আল মোদ্দাসসের– ৪২–৪৬। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নামাজের ব্যাপারে তাঁর উম্মতদেরকে বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন্ উেম্মে মাকতুম (রাঃ) নামক অন্ধ সাহাবী আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূল (সাঃ)-আমি তো একা অন্ধ মানুষ, মদিনা শহর ঘন ঝোপ জঙ্গলে পরিবেষ্টিত–আমি কি ঘরে বসে নামাজ আদায় করতে পারব? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ তুমি পারবে। চলে যাওয়ার সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আবার ডেকে বললেন, ইয়া আবদুল্লাহ উম্মে মাকতুম (রাঃ) তুমি কি আযান শুনো? জবাবে বললেন, হ্যাঁ শুনি– তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমাকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে হবে। তখন এই অন্ধ সাহাবী তাঁর বসতঘরের সাথে মসজিদে রশি আটকিয়ে দিলেন, সেই রশি ধরে ধরে তিনি মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করতেন। একজন অন্ধ ব্যক্তিকেও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ছাড় দেননি। পরবর্তীতে এই অন্ধ সাহাবী মদিনা শহরের দু’বার গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন। অন্য এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, আমার ইচ্ছা হয় বাড়িতে যদি নারী ও শিশু না থাকতো তাহলে আযান শুনে মসজিদে না যাওয়া ব্যক্তিদের ঘর জ্বালিয়ে দিতাম’। আল্লাহর কোরআনে কোন স্থানে নামাজ পড়ার কথা বলা হয় নাই, নামাজ কায়েমের কথা বলা হয়েছে। ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত আদায় কর, আর যারা রুকু করে তোমরা তাদের সাথেও রুকু কর’–সূরা বাকারা–৪৩। যারা নামাজে খুশুখুজু ও একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করে তারাই সফলকাম, ‘নিঃসন্দেহে ঈমানদার মানুষেরা মুক্তি পেয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত থাকে, যারা অর্থহীন বিষয়ে বিমুখ থাকে, যারা রীতিমত যাকাত প্রদান করে, যারা তাদের যৌনাঙ্গসমূহ হেফাজত করে’। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তারা সালাত আদায় করা অবস্থায় অত্যন্ত বিনয়ী হয়। তাদের মন আল্লাহর দিকে ঝুঁকে থাকে এবং অন্যদের প্রতি থাকে বিনম্র। হযরত আলী ইবনে আলী তালহা (রঃ) বলেন, খুশু এর অবস্থান হল অন্তরে। হযরত হাসান বাসরী (রঃ) বলেন, তাদের খুশু থাকে তাদের অন্তরে আর তাদের দৃষ্টি থাকে নিচের দিকে। এই বিনয়ী ও নম্রতা ঐ ব্যক্তি লাভ করতে পারে যার অন্তকরন খাঁটি ও বিশুদ্ধ হয়, সালাতে পুরোপুরিভাবে মনোযোগ থাকে এবং সমস্ত কাজ অপেক্ষা সালাতে বেশি আগ্রহী। তখন মন হয় আনন্দে আপ্লুত এবং চোখে আসে শীতলতা। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘আমার কাছে সুগন্ধি ও মহিলা খুবই পছন্দনীয় এবং আমার চক্ষু ঠান্ডা করে সালাত’-(আহমেদ ৩/১৮৯)। হাদীস শরীফে বর্ণিত, প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করলে যেমন কোন ময়লা থাকে না, তেমনি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করলেও তার সমস্ত গুণাহ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন– (বুখারী–৫২৮)। কবীরা গুণাহ না করলে প্রত্যেক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও জুমাবারে জুমা আদায়ের মধ্যবর্তী সময় হয়ে যাওয়া পাপরাশি এমনিতেই মুছে যায়– (মুসলিম–২৩৩)। আল্লাহর কাছে নিকটবর্তী হওয়া উৎকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে সালাত। বান্দা যখন সেজদায় যায় তখন আল্লাহতায়ালা ও বান্দার মধ্যে কোন হিজাব থাকে না। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, তুমি বেশি বেশি আল্লাহকে সেজদা কর। কেননা তুমি যখনই একটি সেজদা করবে তখনই এর বিনিময়ে জান্নাতে আল্লাহতায়ালা তোমার একটা মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং একটা গুনাহ ক্ষমা করে দেন– (মুসলিম– ৪৮৮)। জামাতে নামাজ পড়লে ২৭ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়– (বুখারী)। যে লোক এক নামাজের পর অপর নামাজের অপেক্ষায় থাকে, যেন তার কলব মসজিদের সাথে ঝুলে আছে, এমন ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা হাশরের মাঠে আরশের ছায়ার নিচে জায়গা দিবেন। বুখারী– ৬৬০। অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে–ফজরের দু’রাকাত সুন্নতের ফজিলত দুনিয়া ও দুনিয়াতে যা কিছু আছে তার থেকে উত্তম -(মুসলিম)। সালাতে সেজদার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করেন এবং আল্লাহতায়ালার একদম কাছে চলে যায়– (মুসলিম)। সালাত হল বান্দার মন্দ কাজের কাফফারা, যতক্ষণ সে কবিরা গুনাহে লিপ্ত না হয়– (মুসলিম)। বুখারী শরীফে বর্ণিত: সালাত হল আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম আমল। আল্লাহর কোরআনে বর্ণিত রয়েছে, সালাত মানুষকে অশ্লীল কাজ থেকে নিবৃত্ত করে, ‘হে নবী, যে কিতাব তোমার উপর নাযিল করা হয়েছে তুমি তা তেলওয়াত কর এবং নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, নিঃসন্দেহে নামাজ অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে’–সূরা–আনকাবুত–৪৫।
আমাদের এই সালাত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। আর এটাই তার পবিত্র কালামে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘তুমি বল অবশ্যই আমার নামাজ, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সব কিছু সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহতায়ালার জন্য’– সূরা–আনআম–১৬২। আল্লাহ সুবাহানুওয়াতায়ালা তাঁর নবীকে আদেশ করেছেন যে, তিনি যেন ঐ সমস্ত মূর্তিপূজক কাফেরদেরকে জানিয়ে দেন, যারা তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে উপাসনা করে এবং কোরবানী করে তাদের এধরনের কাজকে আল্লাহ কখনো গ্রহণ করবেন না। তাঁর জন্য সব ধরনের ইবাদত হতে হবে শরীকবিহীন এবং একমাত্র তারই জন্য।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কোরবানী কর’–সূরা আল কাউসার–২। নিজ সন্তানদেরকে নামাজ পড়ার ব্যাপারে আবশ্যিক তাগিদ দিয়েছেন বিশ্বনবী। ৭ বছর বয়সে নামাজ পড়ার জন্য বলা এবং ১০ বছর বয়সে নামাজ না পড়ার কারণে বেত্রাঘাত করার আদেশ দিয়েছেন স্বয়ং রাসূল (সাঃ)। যেভাবে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর কাছে আরজ পেশ করেছেন এভাবেই, ‘হে আমার রব, তুমি আমাকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানাও, আমার সন্তানদের মাঝ থেকেও (নামাজী বান্দা বানাও), হে আমাদের রব আমার দোয়া তুমি কবুল কর’– সূরা ইব্রাহীম–৪০। শেষ বয়সে অত্যধিক অসুস্থ অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দু’জন সাহাবীর কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে নববীতে জামাতে সালাত আদায় করেছেন। যখন তিনি মসজিদে যেতে পারছিলেন না তখন কিছুটা দাঁড়িয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে মসজিদে নববীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আজকে নামাজের ইমামতি কে করছেন? হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূল (সাঃ)! সাহাবীগণ আপনার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমার বাবার ইমামতিতে নামাজ আদায় করলেন। একথা শুনে রাসূল (সাঃ) এর দু’চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, আপনি কেন কাঁদছেন? রাসূল (সাঃ) বললেন, এটি আমার আনন্দের কান্না। যে নামাজের জন্য তায়েফের ময়দানে আমি রক্তাক্ত হয়েছি, ওহুদের যুদ্ধে দান্ধান মোবারক শহীদ হয়েছেন, যে নামাজের জন্য আমার অসংখ্য সাহাবী শাহাদাতের নজরানা পেশ করেছেন সেই নামাজ আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেজন্যে আমি কাঁদছি।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল