নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষ জনবলের অভাব ও কারিগরি ত্রুটির কারণে সরকারি ওয়েবসাইটে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য উন্মুক্ত ছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সরকারি একটি ওয়েবসাইট থেকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে একটি সাইবার সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান প্রমাণ পেয়েছে। সেই সাইটে দেশের মানুষের নাম, মোবাইল ফোন নম্বর, ই–মেইল ঠিকানা, এনআইডি নম্বরসহ ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যদিও নিরাপত্তার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম প্রকাশ করা হয়নি, তবে সেই প্রতিষ্ঠানটি যে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। তথ্য ফাঁসের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, তথ্য কেউ হ্যাক করে নিয়ে যায়নি। কারিগরি ত্রুটির কারণে তথ্যগুলো উন্মুক্ত ছিল। সেই দিন তিনি নাম না বললেও জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় থেকে যে তথ্য ফাঁস হয়েছে তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। নাগরিকের তথ্য ফাঁসের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর গত ১০ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ। ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির (ডিজিএ) মহাপরিচালক আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামানকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এ বিষয়ে আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান জানান, নির্ধারিত সময়ের শেষ কর্মদিবসে গত বৃহস্পতিবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন পত্রিকান্তরে বলেন, ‘আমি এখনো হাতে পাইনি। মন্ত্রী মহোদয় দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি আসলে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন।’ এ দিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, নাগরিকের তথ্য ফাঁসের ঘটনা প্রকাশের পর থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় থেকে এনআইডি সেবা দেওয়া বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুঈদ রহমান সাইবার নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টদের উদ্ধৃতি দিয়ে এক লেখায় লিখেছেন, ‘সাইবার নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের তথ্য সুরক্ষা ঝুঁকিতে পড়েছে মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয়কে অপচয় মনে করে। দ্বিতীয়ত, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের অধিকাংশই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত নন। তৃতীয়ত, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হলে তারা গুরুত্ব দেন না। এসব কারণেই ঝুঁকি তৈরি হয়। হ্যাকাররা তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটগুলোর দুর্বলতাকেই মূলত কাজে লাগান। অথচ উন্নত দেশগুলো তথ্য সুরক্ষায় প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। গড়ে তুলছে ফায়ার ওয়াল।’
আসলে আমরা শুধু কথায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বলছি, কিন্তু এখনো তা হয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের অধিকাংশ কাজ এখনো অ্যানালগ। কিছু কিছু কাজ ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করার সক্ষমতা অর্জন করার কারণে আমরা নিজেদের ডিজিটাল বলছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটা রাষ্ট্র ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য যে ধরনের দক্ষতা অর্জন, দক্ষ লোক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন হয়, এর কোনোটাই এখন পর্যন্ত আমরা অর্জন করতে পারিনি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ বিষয়ে ২০১০ সালের যে জাতীয় পরিচয়পত্রসংক্রান্ত আইন, সেটা সুস্পষ্টভাবে এ ঘটনায় লঙ্ঘন হয়েছে। কারণ এ ঘটনায় জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং ব্যক্তির অন্যান্য মাধ্যম থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে। সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদ ধারায় যোগাযোগ থেকে শুরু করে চিঠিপত্র আদান–প্রদান এবং ব্যক্তিগত–সবকিছুর গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে তথ্যের কথাটি সরাসরি উল্লেখ নেই, কিন্তু আমরা ব্যাখ্যা করে বলতে পারি, এ ধারাটায় আমাদের উপাত্তের সুরক্ষা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা আছে। যোগাযোগও তো উপাত্তের মধ্যে পড়ে। এ ঘটনায় এর লঙ্ঘন হয়েছে, সেটা বলা যাবে। আর জীবনের সঙ্গে তো অভিজ্ঞতাও জড়িত। কোনো ঘটনায় কোনো ব্যক্তির জীবন যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়, সেটা তার ক্ষতিরও ব্যাপার। তাই এ ঘটনায় ব্যক্তির জীবনের যে কোনো ধরনের ক্ষতি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা যে আছে, এটা আমরা বলতে পারি।’ দক্ষ জনবলের অভাব ও কারিগরি ত্রুটির কারণে নাগরিকের তথ্য ফাঁসের যে ঘটনা ঘটেছে, সেটার দায়ও নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এ দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।