বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ পুনরায় চালুর পর গত তিন মাসে বিদেশগামী যাত্রীর সংখ্যা অন্তত তিনগুণ বেড়েছে। বিদেশগামী যাত্রীর সংখ্যা বাড়ায় করোনার নমুনা পরীক্ষার চাপও বেড়েছে সমানতালে। এতে করে বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রামে নির্ধারিত দুটি (বিআইটিআইডি ও চমেক) ল্যাব চাপে হিমশিম। বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষায় প্রাধান্য দিতে গিয়ে পুনরায় সাধারণের নমুনা জটের শঙ্কা ভর করেছে চট্টগ্রামে। বিআইটিআইডি ল্যাবের প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ ও চমেক (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ) ল্যাবের ইনচার্জ অধ্যাপক ডা. এহসানুল হক কাজল এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বিও বলছেন, চমেক ল্যাবে এতদিন একদিন পরই রিপোর্ট পাওয়া যেতো। কিন্তু গত কয়দিন ধরে রিপোর্ট পেতে দু’দিন লাগছে। বিদেশগামী যাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণের নমুনার সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামের প্রধান দু’টি ল্যাবে বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষায় প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। এতে করে সাধারণের রিপোর্ট পেতে আগের মতো কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। তবে বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো হলে এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্ভব বলে মনে করেন সিভিল সার্জন।
প্রসঙ্গত, বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা পরীক্ষার সনদ বাধ্যতামূলক করে গত ১৮ জুলাই নির্দেশনা জারি করে সরকার। যাত্রার আগের ৭২ ঘণ্টার (তিনদিন) মধ্যেই নমুনা প্রদান এবং যাত্রার আগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয় বিদেশগামীদের। অর্থাৎ নির্দেশিত সময়ের বাইরে নমুনা প্রদান ও রিপোর্ট নেয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদেশ যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষায় কোন কোন ল্যাবের রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য, তাও নির্ধারণ করে দেয়া হয় নির্দেশনায়। প্রথমে চট্টগ্রামে কেবল বিআইটিআইডি ল্যাবের রিপোর্টই বিদেশগামীদের জন্য গ্রহণযোগ্য হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ল্যাবকেও এর সাথে যুক্ত করা হয়।
নির্দেশনা জারির পর ২০ জুলাই থেকে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষায় রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্নকারীদের নমুনা নেয়া হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। প্রথম কয়দিন রেজিস্ট্রেশন ও নমুনা প্রদানে বিদেশগামীদের উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ে। দিনে দিনে বিদেশগামীদের এ ভিড় কেবল বাড়ছেই।
বিদেশগামীদের মাস ভিত্তিক নমুনা পরীক্ষার চিত্র : করোনা পরিস্থিতিতে বেশ কিছুদিন অন্যান্য দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। তবে জুলাইয়ের শুরুর দিকে হাতেগোনা কিছু সংখ্যক দেশের সাথে পুনরায় বিমান চলাচল শুরু হয়। যদিও ১৮ জুলাইয়ের পর বিমান ভ্রমণে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০ জুলাই থেকে চট্টগ্রামে বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষা চালু হয়।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে- চালুর পর জুলাইয়ের শেষ ১২ দিনে (২০-৩১ জুলাই পর্যন্ত) ১ হাজার ৯৪৪ জন বিদেশগামী যাত্রীর নমুনা পরীক্ষা হয় চট্টগ্রামে। এতে ৪০ জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। আগস্ট মাসে নমুনা পরীক্ষা হয় ৫ হাজার ৪১৭ জনের। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত হয় ২২৬ জনের। সেপ্টেম্বরে নমুনা পরীক্ষা করানো বিদেশগামী যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৬৯৪ জন। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয় ১৪৪ জনের। অক্টোবরে ১২ হাজার ৮৮৫ জন বিদেশগামী যাত্রীর নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এতে করোনা শনাক্ত হয় ২২১ জনের। আর নভেম্বরে নমুনা পরীক্ষা করানো বিদেশগামীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজার ২৫২ জনে। এর মধ্যে ২০৬ জন বিদেশগামীর করোনা শনাক্ত হয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়- আগস্ট মাসে বিদেশগামী যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৪১৭ জন। তবে নভেম্বরে বিদেশগামী যাত্রীর এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজার ২৫২ জনে। হিসেবে তিন মাসে বিদেশগামীর সংখ্যা অন্তত তিনগুণ বেড়েছে।
বিদেশগামীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও তাদের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবের সংখ্যা আর বাড়েনি চট্টগ্রামে। এখনো নির্ধারিত দুটি ল্যাবেই (বিআইটিআইডি ও চমেক) বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষা সীমাবদ্ধ আছে। কিন্তু মাঝখানে কিছুদিন সংক্রমণ কমলেও মাস দেড়েক ধরে করোনা শনাক্তের হার ফের ঊর্ধ্বমুখি। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। কিন্তু চট্টগ্রামের প্রধান দুটি (বিআইটিআইডি ও চমেক) ল্যাবে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষায়। এতে করে আগের মতো বেশি সংখ্যায় সাধারণের নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিআইটিআইডি ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের ল্যাবে আগে দিনে পাঁচশ’র মতো নমুনা পরীক্ষা হতো। এর মধ্যে বেশির ভাগই থাকতো সাধারণের নমুনা। কিন্তু এখন প্রতিদিন ৭’শ বা এরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করতে হয়। যার মধ্যে বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনাই থাকে সিংহ ভাগ। এর ফলে সাধারণের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যাটা কমে আসছে। এভাবে চললে কয়েকদিনের মধ্যে আগের মতো নমুনার জট দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। একই কথা বলেছেন চমেক ল্যাবের ইনচার্জ অধ্যাপক ডা. এহসানুল হক কাজল। তিনি বলেন, বর্তমানে দিনে ৫ শতাধিক নমুনা পরীক্ষা হয় আমাদের ল্যাবে। এর মধ্যে ২ থেকে ৩শ’ নমুনা থাকে বিদেশগামীদের। তাদের নমুনার সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকায় সাধারণের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ও সুযোগ পর্যায়ক্রমে কমে আসছে। এর ফলে সাধারণের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়াটা আগের তুলনায় বিলম্বিত হতে পারে বলে মনে করছেন চমেক ল্যাব ইনচার্জ।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চট্টগ্রামের ল্যাবগুলোতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে দৈনিক গড়ে এক হাজারের কম নমুনা পরীক্ষা হতো। তবে অক্টোবর ও নভেম্বরে এ সংখ্যা গড়ে দেড় হাজারে পৌঁছেছে। দিনদিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সামপ্রতিক সময়ে দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ১ হাজার ৮০০ ছাড়িয়েছে। বিআইটিআইডি ও চমেক ল্যাব ছাড়াও সরকারি পর্যায়ে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেনারেল হাসপাতালের আরটিআরএল সেন্টারে নমুনা পরীক্ষা হয়ে থাকে চট্টগ্রামে। এর বাইরে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবেও চট্টগ্রামের দুটি উপজেলার (লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া) নমুনা পরীক্ষা হয়ে থাকে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল, শেভরণ ল্যাব এবং আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে।
বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানই বিদেশগামী যাত্রীদের করোনার নমুনা পরীক্ষার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। অনুমতি পাওয়া সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানেও বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষা চালু হলে নমুনা জটের শঙ্কা আর থাকবে না বলে মনে করেন সিভিল সার্জন। তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পেলে অন্তত সামর্থ্যবান একটি অংশ বেসরকারি এসব ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ পাবে। এতে করে সরকারি ল্যাব দুটিতে চাপ কিছুটা হলেও কমবে।