পৃথিবীর ছয় প্রকারের ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণ বৈচিত্রময় বাস্তু সংস্থানতন্ত্র বলা হয় নদী বা মিঠা পানির উৎসকে। কৃষি ও পানীয় জলের নিশ্চয়তা এবং উর্বরা ভূমির কারণে পৃথিবীর আদি সভ্যতাগুলোও নদী তীরেই গড়ে ওঠে বলে ধারণা করা হয়। কোনো নদীর টিকে থাকার উপর নির্ভর করছে কোন সভ্যতার অস্তিত্ব। তাই নদীর গুরুত্ব তুলে ধরতে আজ ১৪ মার্চ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশেও পালন করা হচ্ছে বিশ্ব নদী রক্ষা দিবস।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্র হল– উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, পানি এবং অণুজীবগুলি যেখানে একসাথে বসবাস করে এবং অস্তিত্বের জন্য একে অপরের উপর নির্ভর করে। বাস্তুতন্ত্র বন্য গাছপালা এবং প্রাণীদের বাসস্থান সরবরাহ করে, বিভিন্ন ফুড চেইন ও খাবারের ওয়েবগুলিকে ঠিক রাখে, প্রয়োজনীয় পরিবেশগত প্রক্রিয়া ও জীবন ধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। জৈব ও জৈব উপাদানগুলির মধ্যে পুষ্টি পুনর্ব্যবহারের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। বাস্তুতন্ত্র জলচক্র, কার্বন চক্র, অঙিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র ও শক্তি চক্রসহ একই বাস্তুতন্ত্রের শক্তির যথাযথ প্রবাহ বজায় রাখে।
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ কৃষিকাজে সেচের জন্য, পানীয় জলের জন্য, মালামাল পরিবহন ও যাতায়াতের জন্য নদীকে ব্যবহার করে আসছে। আর গত শতাব্দী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও নদীকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এছাড়া সাঁতার এবং নৌযান চালানোর মতো অবকাশ যাপনের জন্যও নদীর ব্যবহার হয়ে আসছে। আর নদীর এই ব্যবহারকে ঘিরে গড়ে ওঠছে বৈচিত্র্যময় সভ্যতা ও সংস্কৃতি। দেশের উচ্চ আদালত নদীকে একটি ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসাবে ঘোষণা করেছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী ছিদ্দিকী বলেন, পরিবেশে বা বাস্তুতন্ত্রে একটি নদী এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, এর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করছে মানুষসহ ওই বাস্তুতন্ত্রের সকল প্রাণের অস্তিত্ব। এ কারণে উচ্চ আদালত দেশের সকল নদ– নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ বা জীবন্ত সত্তা হিসাবে ঘোষণা করেছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে কয়েক লক্ষ স্বতন্ত্র বাস্তুুতন্ত্র রয়েছে। একটি পুকুর বা কুয়াকে কেন্দ্র করেও স্বতন্ত্র বাস্তুুতন্ত্র গড়ে ওঠতে পারে। তবে পৃথিবীতে মূলত ৬ ধরনের বাস্তুুতন্ত্র রয়েছে। এরমধ্যে বনভূমি, তৃণভূমি, মরুভূমি, মিঠা পানি ও সামুদ্রিক পানির জলাধার এবং আর্কটিক টুন্ড্রা অন্যতম। আর এসব বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মানুষের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হল মিঠা পানির জলাধার বা নদীর বাস্তুতন্ত্র।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন –বাপা জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, কঙবাজারের দুটি প্রধান নদী বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর উপর নির্ভর করছে এখানকার প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা। অথচ বাঁকখালী এখন দখল ও দূষণের কবলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে।
তিনি বলেন, কঙবাজার জেলা শহর বাঁকখালী তীরে অবস্থিত। আর এ নদী নিয়ে এখন আদালতে ৮টি রিট রয়েছে। যা দেশের আর কোনো নদী নিয়ে নেই।
এই পরিবেশবাদী আরও বলেন, বাঁকখালী নদী দখল হওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতা আছে। আছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা। অনেক প্রভাবশালী নদী দখলে জড়িত। একদিনে এ নদী দখল হয়নি। আমি মনে করি, বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের কখনোই পুনর্বাসন করা উচিত হবে না। অবৈধ দখলদার হিসেবেই তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন বলুন, আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলুন প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে দখল প্রক্রিয়ায় যুক্ত। অনেক জমির খতিয়ান হয়েছে, নামজারি হয়েছে–এটি কিভাবে হলো?
বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনছারুল করিম বলেন, বাংলাদেশ নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বিশ্বের জল ব্যবস্থাপনার সাথে মিতালী রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন উঁচু অঞ্চলের জল বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে মিশে যাচ্ছে। এসব জল বিভিন্ন নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ায় এখানকার জমির উর্বরতা বেশি। যার কারণে বিশ্বে সবচেয়ে উর্বর ভূমির দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই আমাদের দেশের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, সবোর্পরি নিজের স্বার্থে নদী রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।