সার্ভেয়ার ওয়াসিমের গ্রেপ্তারের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে গত কয়েক মাস ধরে প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কোটিপতি দালালেরা গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে বর্তমানে কক্সবাজার এলএ শাখা ঘিরে তৃতীয় সারির ৩০ দালালের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর নীরবে বদলি হয়ে যাওয়ার ঘটনাও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে বদলি হয়ে আসা নতুনরা কমিশন বাণিজ্যের নতুন ছক আঁটছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পুরনো কর্মকর্তাদের নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রিত অনেকেও নতুন করে পদায়ন হয়েছেন বলে অভিযোগ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাইরে ক্ষতিপূরণে কমিশন বাণিজ্য বাদেও আগাম চেক কেনার বাণিজ্যেও অনেকের নতুন করে কোটি কোটি টাকা লগ্নি করার অভিযোগ উঠছে।
কক্সবাজারে গভীর সমুদ্র বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, জ্বালানি পাইপলাইন প্রকল্প, পিবিআইয়ের দপ্তর, বিমানবন্দর ছাড়াও গড়ে উঠছে টুরিস্ট জোন। সব মিলিয়ে ৭০টির মতো প্রকল্পে প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে কক্সবাজার জেলা জুড়ে। অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার একর জমি। জমি অধিগ্রহণের (এলএ) ক্ষতিপূরণের কমিশন ব্যবসার দালালিতে জড়িয়ে পড়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী, সাংবাদিক ছাড়াও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীও। দালালের তালিকায় রয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তাও।
সূত্রে জানা গেছে, ১৯ ফেব্রুয়ারি র্যাবের অভিয়ানে ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকাসহ গ্রেপ্তার হন কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াশিম খান। ওই ঘটনায় ১০ মার্চ চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে সার্ভেয়ার ওয়াসিমকে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করেন। তিনি মামলাটির তদন্তভারও পান। এরপর মামলা তদন্তে নেমে ২২ জুলাই কক্সবাজারের শীর্ষ দালাল সেলিম উল্লাহ এবং ৩ আগস্ট দালাল সালাউদ্দিন ও কামরুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ এলএ মামলার মূল নথি, ঘুষ লেনদেনের হিসাব লেখা রেজিস্ট্রার উদ্ধার করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এসব নথি থেকে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা এবং লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত হন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। চার আসামি পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের স্বীকারোক্তিতে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ লেনদেনে উঠে আসে প্রায় দেড়শ দালালের নাম। এসব দালালের মাধ্যমে কমিশনে জমির ক্ষতিপূরণ ছাড় দিয়েছেন এলএ শাখার কর্মকর্তারা।
আসামিদের স্বীকারোক্তিতে ক্ষতিপূরণ লেনদেন কাজে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক ৫৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে ৩০ জন সার্ভেয়ার, ৮ জন কানুনগো, ১০ জন অফিস সহকারী, ৩ জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, ৫ জন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) নাম। আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে আসে, কাকে কিভাবে কমিশনের টাকা দিয়েছেন।
তবে প্রায় দেড় মাস আগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আবসার গোপনে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। এর আগে বেশ কয়েকবার বদলির আদেশ হলেও পরে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু সর্বশেষ বদলি হয়ে গেলেও ওই আদেশ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়নি। বর্তমানে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অধিশাখা-৬) হিসেবে পদায়িত হয়েছেন। একইভাবে কক্সবাজার সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মক্তারও নীরবে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম বিআরটিএতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেছেন। তার বদলি আদেশও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়নি।
এদিকে দুদকের অভিযানের মুখে পুরনো দালালদের গা ঢাকার সুযোগে নতুন করে এলএ কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন অনেকে। আজাদীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অন্তত ৩০ দালালের নাম। জানা গেছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার, পিয়ন ও কম্পিউটার অপারেটরের নামও উঠে এসেছে নতুন দালালের তালিকায়। এর মধ্যে ঝাউতলার ওসমান, সাইফুল, বড় মহেশখালীর জাকের, ইনানীর আরিফ, দুদকের মামলায় নাম আসা কালামারছড়া ভূমি অফিসের তহসিলদার জয়নাল আবেদীনের দুই ভাই, পিয়ন ইউছুপ, বাহারছড়ার তৈয়ব, নুনিয়াছড়ার নুরুল আলম, ধলঘাটার আবছার, মহেশখালীর হোয়ানকের শাহাদাত, রহিম বি, হোয়ানক বড়ছড়া এলাকার জাহেদের নেতৃত্বে ৫/৬ জন, কক্সবাজার সদরের ওসমানের নেতৃত্বে ৫/৬ জন, তারাবুনিয়া ছড়ার ম. ইসহাক, কেরনতলীর হাশেম, ফতেহআলী, শাহাবুদ্দিন, মাতারবাড়ির বাবরের নাম উঠে এসেছে নব্য দালালের তালিকায়।
এ বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার দায়িত্ব পালনকারী কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ আজাদীকে বলেন, আমরা সমালোচনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কাজ করছি। এলএ শাখার অনিয়ম দূর করতে শুধু কর্মকর্তা- কর্মচারী নন, ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য ব্যক্তিদেরও সহযোগিতা লাগবে।
এলএ শাখা ঘিরে নতুন করে ৩০ দালালের দৌড়ঝাঁপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে এলএ শাখা নিয়ে নতুন কোনো দালালের বিষয়ে আমাদের জানা নেই। কেউ এলএ শাখার ক্ষতিপূরণ নিয়ে দালালি কিংবা কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।