বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে ভাবনা, আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক–বিতর্ক, পাঠ্যবই এর ভুল–ভ্রান্তি, সংশোধনী সহ যাবতীয় বিষয়ের সমাপ্তিমূলক সমাধান এর প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষানুরাগী জনগণ। বিশেষ করে শিক্ষাক্রমের বিষয়, মূল্যায়নের বিষয়, মূল্যায়নের পদ্ধতি মূল্যায়নের ধরন ইত্যাদির সমাধান, বর্তমান শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরাধ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন এর ধরনের জন্য বেশি উদ্বিগ্ন এবারের নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের সাথে সম্পর্কিত শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলে। নবম শ্রেণির ষান্মাসিক মূল্যায়ন পদ্ধতির ব্যবহার একেবারে সন্নিকট বিধায় এ উদ্বিগ্নতা স্বভাবতই যৌক্তিক। তবে দশম শ্রেণির সিলেবাস এর ওপরই এসএসসি পরীক্ষা হচ্ছে এবং ২০২৬ সালের প্রথম নতুন শিক্ষাক্রম এর উপর অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষাও দশম শ্রেণির পাঠ্যবই অনুযায়ী– ই হবে। আশার কথা খুব শীঘ্রই মূল্যায়ন পদ্ধতি এর সমাধান হতে যাচ্ছে।
শিক্ষাক্রম নতুন করে পরিবর্তন করতে হয়, যুগের চাহিদার প্রয়োজনে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় ব্যবহারিক প্রক্রিয়ার এ যুগে বিশ্ব চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাক্রম বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য অপরিহার্য। নতুন শিক্ষাক্রম অধিকতর যোগ্যতা, পারদর্শীতা ও দক্ষতা সৃষ্টির প্রয়াসেই পরিবর্তন করা হয়েছে বলে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্বাহী কর্মকর্তাদের অভিমত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশে, বিশেষ করে মুখস্থ শিক্ষার উপর নির্ভরতা কমাতে সরকার পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনছে’। যে পরিবর্তনকে নতুন শিক্ষাক্রম বলা হচ্ছে। এই নতুন শিক্ষাক্রম ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা–২০২১’ রূপে ২০২১ সাল থেকে প্রণয়ন করা হয়েছে এবং চলমান রয়েছে, এবং এই ধারাবাহিক পরিবর্তন প্রক্রিয়া ২০২৭ সাল পর্যন্ত চলবে। অর্থাৎ ২০২৭ সালে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ও উচ্চ মাধ্যমিক সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়েই শিক্ষাপদ্ধতির পরিপূর্ণ যাত্রা শুরু হবে।
শিক্ষাক্রম পরিবর্তন এর কারণ বা প্রয়োজন সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে শুধু মুখস্থবিদ্যা শিখবে না,একটা শিশুর ভেতর যে মেধা ও মনন থাকে,সেটাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া। তার এই মেধা দিয়েই যেন সে এগিয়ে যায়। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে “। যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, মেধা–মনন নিয়ে বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে গড়ে তোলার প্রয়াসেই শিক্ষাক্রম এর পরিবর্তন, কিন্তু এ পরিবর্তন প্রক্রিয়া ধীর লয়ে চলছে বলে, বিশিষ্টজনদের আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশেষত কিছুদিন ধরেই নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন কেমন হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য আশ্বস্ত করে বলছেন, চারদিক বিবেচনা করে এবং আলোচনা সমালোচনা সবকিছুকে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সকলের গ্রহণযোগ্য সমাধানের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রম এর কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
ইতিমধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নপদ্ধতি চূড়ান্তকরণের কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য গঠিত কমিটি কর্তৃক সিদ্ধান্ত অনুমোদন এর অপেক্ষায় আছে বলে বিভিন্ন অনলাইন সংবাদ সহ প্রথম আলো এর প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। সুপারিশকৃত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাবলিক পরীক্ষা তথা এসএসসি পরীক্ষায় লিখিত অংশের ওয়েটেজ ৬৫ শতাংশ এবং কার্যক্রম ভিত্তিক অংশের ওয়েটেজ ৩৫ শতাংশ।মোট পাঁচ ঘন্টায় (বিরতি সহ) হবে প্রতিটি বিষয় এর পরীক্ষা। কার্যক্রমভিত্তিক মানে এসাইনমেন্ট করা, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান করা,পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি। লিখিত অংশের প্রশ্নপত্র হবে কার্যক্রম এর বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে, অর্থাৎ প্রশ্ন হবে দুই অংশের মধ্যে আন্তসম্পর্ক বজায় রেখে।
নতুন শিক্ষাক্রমে আরোও অনেক নতুন বা প্রথম কে নিয়ে যাত্রা শুরু হচ্ছে যেমন আগের গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (জিপিএ) এর বদলে শিক্ষার্থীর অগ্রগতি বোঝাতে ত্রিভুজ, বৃত্ত,ও চতুর্ভুজ ব্যবহৃত হবে। ত্রিভুজ মানে সবচেয়ে ভালো বা দক্ষ। বৃত্ত মানে মোটামুটি ভালো, এবং চতুর্ভুজ হচ্ছে উন্নতি প্রয়োজন।
নতুন শিক্ষাক্রম এর সুপারিশকৃত মূল্যায়ন পদ্ধতি অবশেষে চূড়ান্ত হওয়ার পথে।এতে বার্ষিক ও ষান্মাসিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া থাকবে, যা নির্ধারিত পারদর্শিতা অনুযায়ী সাতটি ধাপ বা স্কেলে ফল বা রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করা হবে। যে সাতটি স্কেলে মূল্যায়ন পদ্ধতি তা হলো—প্রারম্ভিক (এলিমেন্টারি), বিকাশমান (ডেভলাপিং), অনুসন্ধানী (এক্সপলোরিং), সক্রিয় (এক্টিভেটিং) অগ্রগামী (এডভান্সিং), অর্জনমুখী (এচিভিং) ও অনন্য (আপগ্রেডিং)।
এনসিটিবি সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে জানা যায়, রিপোর্ট কার্ডে শিখনকালীন মূল্যায়ন ও পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন এর ফলাফল আলাদাভাবে উপরোক্ত সাত স্তরে সাতটি ছকে প্রকাশিত হবে। এখানের ‘প্রারম্ভিক স্তর‘ হলো সবচেয়ে নীচের স্তর, আর ‘অনন্য‘ হলো শিক্ষার্থীর সব বিষয়ে পারদর্শিতার চূড়ান্ত স্তর। যদি শিক্ষার্থী দুটি বা তিনটি বিষয়ে পারদর্শিতার স্তর ‘প্রারম্ভিকে ‘থাকে, তবে সেই শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে উঠতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞ মতামত এর ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, এই নতুন শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হবে, কারণ —১. শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত আদর্শ মানে না থাকা। ২. শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত শিক্ষকের অভাব। ৩.মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষকদের ওপর নির্ভরযোগ্যতার সংশয়। ৪.পর্যাপ্ত তথ্য প্রযুক্তি যুক্ত শ্রেণিকক্ষের অভাব। ৫. নৈপুণ্য ব্যবহারে শিক্ষকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। ৬. অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টজনের শিক্ষাক্রম নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব। এবং ৭. সর্বোপরি জলবায়ুর প্রভাব বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো ঘটনা শিক্ষাক্রমের কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়,অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম এর রুটিন কার্যক্রমও বাধার মুখে পড়বে। এ প্রসঙ্গে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহীবুল হাসান চৌধুরী এক বক্তৃতায় তাঁর দূরদর্শী ভাবনার প্রতিফলনে বলেন, ‘নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ছুটি ঠিক রাখাটাও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। আমাদের বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম এক্টিভিটি–ভিত্তিক,এ কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি সময় খোলা রাখতে হচ্ছে,ফলে ছুটি ঠিক রাখা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠছে, এটাও একধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাকে সাথে নিয়ে সরকার নতুন শিক্ষা কারিকুলাম পরিচালনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হয়। এসব চ্যালেঞ্জ কে মাথায় রেখে ইতিমধ্যে সারা দেশের শিক্ষকদের বিভিন্ন স্তরে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সেটার,মডারেটর, পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক,ইনভিজিলেটর ইত্যাদি সমস্ত টায়ারে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাতে নতুন সাত স্কেলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে সক্ষম হন। অন লাইন প্রতিবেদন ও বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত ২০২৪ সালের বইয়ের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও গভীর পর্যবেক্ষণ করে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, তা গুরুত্বের সংগে বিবেচনা করে এবং যৌক্তিক মূল্যায়ন করে সংশোধনী প্রদান এসব বিষয়ে কাজ করেই এগোতে হচ্ছে বিধায় কিছুটা কালক্ষেপণ হচ্ছে।এনসিটিবির চেয়ারম্যান এর রুটিন দায়িত্বে থাকা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদেরকে প্রশ্নোত্তরে বলেন,”শিক্ষকবৃন্দের প্রশিক্ষণ ধারাবাহিক ভাবে দেওয়া হচ্ছে।প্রশিক্ষণ বছরব্যাপী চলমান থাকবে।প্রশিক্ষণ দিয়ে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়েছে। মাস্টার ট্রেইনাররা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।অভিভাবকরা একসময় বুঝতে পারবেন সবকিছু। শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না। ফলে চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো’।
আশার কথা এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁরা ইতিমধ্যে মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করেছেন, শুধু আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমটুকু শেষ হলেই প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে বার্তা পাঠাবেন।
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম চালু হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে এটা বিশ্বাস করার সাথে সাথে এটাও বিশ্বাস করতে হবে,শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার মান উন্নয়ন বা নতুন শিক্ষা কারিকুলাম চালুকরনে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাই সামনের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট বাড়ার উপর নির্ভর করবে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম পরিচালনার সফলতা ও সার্থকতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ।