দেশের পঞ্চবিংশতম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন হাই কোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ; যাকে নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গতকাল শনিবার রাতে রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে তার এ নিয়োগ কার্যকর হবে।
ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে এদিন পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে এদিন পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল করিম বলেন, যেহেতু তিনি (সৈয়দ রেফাত আহমেদ) সরাসরি হাই কোর্ট ডিভিশন থেকে প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন, সেক্ষেত্রে একবারই শপথ নিলে হবে। তিনি আপিলেট ডিভিশন এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে একইসঙ্গে শপথ নেবেন।
হাই কোর্টের বিচারপতিদের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। দুই বছর পর ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল হাই কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। তার বাবা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বাংলাদেশের প্রথম অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল। প্রয়াত ইশতিয়াক আহমেদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুইবারের উপদেষ্টা ছিলেন।
রেফাত আহমেদের মা জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ছিলেন। সৈয়দ রেফাত ১৯৮৪ সালে ঢাকা জেলা আদালতে এবং ১৯৮৬ সালে হাই কোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন।
পদ ছাড়লেন ওবায়দুল হাসান : ক্ষমতার পালাবদলে বিচারালয়ের শীর্ষ পদ থেকে সরে যাওয়ার দাবি প্রবল হওয়ার পর পদত্যাগে বাধ্য হলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। গতকাল শনিবার বিকালে ফেইসবুকে এক ভিডিও বার্তায় এ খবর দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন ও বিচার উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের প্রধান বিচারপতি কিছুক্ষণ আগে পদত্যাগ করেছেন। উনার পদত্যাগপত্র ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে এসে পৌঁছেছে। এটা উপযুক্ত প্রসেসিংয়ের জন্য আমরা কালবিলম্ব না করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেব। এবং আমি আশা করব যে এটা খুব দ্রুত, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। খবর বিডিনিউজের। এদিকে বাংলানিউজ সূত্রে জানা গেছে, আপিল বিভাগের ৫ জন বিচারপতিও পদত্যাগ করেছেন।
এক সময় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্ব পালন করা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের চতুর্বিংশতিতম প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তার বিচার অঙ্গনের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তার ধাক্কায় মেয়াদপূর্তির দেড় বছর আগেই প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে হলো।
শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে আন্দোলনকারীরা গতকাল আপিল বিভাগের সব বিচারকের পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘোরাও করে। তাদের দাবি মানা না হলে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘেরাওয়েরও হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
প্রধান বিচারপতি সকালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে ফুলকোর্ট সভা আহ্বান করলেও আন্দোলনকারীরা ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়ার পর তা স্থগিত করা হয়। ফুলকোর্ট সভা আহ্বানের পর পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট ও নানান অপকর্মে জড়িত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে ফুলকোর্ট মিটিং ডেকেছেন। পরাজিত শক্তির যে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। আইনজীবীরা এরই মধ্যে এর প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন। আমরা আগেই প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ছাত্র–জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের উসকানি দিলে এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। অনবিলম্বে বিনা শর্তে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করুন এবং ফুল কোর্ট মিটিং বন্ধ করুন।
এর পরপরই প্রধান বিচারপতির ডাকা ফুলকোর্ট সভা স্থগিত করার খবর পাওয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, পদত্যাগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আর বিকালে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের খবর দেন আইন উপদেষ্টা।
তবে কেবল প্রধান বিচারপতির পদত্যাগপত্রই মন্ত্রণালয় পেয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা ভিডিও বার্তায় বলেন, অন্যদের ব্যাপারে কোনো আপডেট নাই। আপনারা সবাই শান্ত থাকবেন। দেশের সম্পদ নষ্ট করবেন না।
এরপর কী : পরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, পরবর্তী (প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ) প্রক্রিয়াটা হচ্ছে, আইন উপদেষ্টা হিসেবে আমার স্বাক্ষরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অফিসে যাবে। উনি এখন রংপুরে আছেন বা সম্ভবত বিমানে আছেন, তিনি নেমে আসার পর তার সম্মতি সাপেক্ষে এটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। রাষ্ট্রপতি এটা গ্রহণ করলে কার্যকর হবে। আমরা আশা করছি এটা আজকের মধ্যেই হবে। এর পরপর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।
আন্দোলনকারী ছাত্ররা আপিল বিভাগের অন্য বিচারকদের পদত্যাগেরও দাবি করছে। এ বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, আপিল বিভাগের আরও যারা আছেন তাদের পদত্যাগের দাবির কথা আমি শুনেছি। শুনেছি অন্যরাও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এখনো পদত্যাগপত্র আইন মন্ত্রণালয়ে আসেনি।
বদলে যাওয়া পরিস্থিততে গত বুধবার পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনার সময় নিয়োগ পাওয়া অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান, বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের চতুর্বিংশতিতম প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ সেপ্টেম্বর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বিচারাঙ্গনের সর্বোচ্চ পদে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর স্থলাভিষিক্ত হন।
সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, ৬৭ বছর বয়স, অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তার প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ইসি নিয়োগের সর্বশেষ সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন।
আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির পদত্যাগ : প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পর আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। গতকাল এ তথ্য জানিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র। রাষ্ট্রপতি বরাবর এ পদত্যাগপত্র দেওয়া হয়। পদত্যাগ করা পাঁচ বিচারপতি হলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফরি সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. কাশেফা হোসেন। এখন আপিল বিভাগে শুধু রইলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম।