নতুন প্রজন্মের বিজয়

রুদ্র দাস | বুধবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

ছোট্ট গ্রামের নাম জয়পুর। সবুজ মাঠ, পাখির গান আর মেঠোপথে ঘেরা গ্রামটি যেন প্রকৃতির একটি ছোট্ট গহনা। এই গ্রামে থাকত বারো বছরের একটি ছেলে, নাম তার তুহিন। তুহিন খুবই কৌতূহলী ও সাহসী। সবসময় নতুন কিছু জানার আগ্রহ তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলত।

ডিসেম্বর মাসের এক সকালে তুহিন তার দাদুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

দাদু, বিজয় দিবস কী? আমরা কেন ১৬ ডিসেম্বর উৎসব করি?”

দাদু হাসিমুখে বললেন,

এটা আমাদের গৌরবের দিন, বাছা। এই দিনে আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করেছি। তুমি জান, আমাদের স্বাধীনতার জন্য অনেক মানুষ জীবন দিয়েছেন?”

তুহিন বিস্মিত হয়ে বলল,

তাহলে তাদের গল্প শোনাও দাদু। আমি জানতে চাই।”

দাদু গল্প শুরু করলেন,

১৯৭১ সালে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়নি। তখন পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের উপর অনেক অত্যাচার করত। তারা আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। আমাদের মুক্তির জন্য শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধে গ্রামের মানুষ থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষিত যুবকেরা পর্যন্ত অংশ নিয়েছিল। তারা জানত, স্বাধীনতার জন্য কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তবু কেউ পিছু হটেনি।”

তুহিন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এরপর সে বলল,

দাদু, আমরা কি মুক্তিযোদ্ধাদের কখনো দেখেছি?”

দাদু উত্তরে বললেন,

হ্যাঁ, গ্রামের মতিন চাচা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তুমি যদি তার কাছে যাও, তবে তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা বলবেন।”

তুহিন পরদিন সকালেই মতিন চাচার কাছে ছুটে গেল। মতিন চাচা তাকে দেখে বললেন,

তুহিন, কী খবর? এত সকালে কেন এসেছো?”

তুহিন বলল,

চাচা, আমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে এসেছি। দাদু বলেছিলেন আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।”

মতিন চাচার মুখে একগাল হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন,

১৯৭১ সালে আমি ছিলাম তোমার বয়সী। আমার বড় ভাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। একদিন সে বলল, ‘দেশকে স্বাধীন করতে হবে, তুইও চল আমার সাথে।’ আমি ভয় পেলেও রাজি হয়ে গেলাম। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রশিক্ষণ নিলাম। শত্রুদের সাথে অনেকবার লড়াই করেছি। জানিস, একদিন শত্রুরা আমাদের গ্রামে আক্রমণ করল। আমরা গোপনে পরিকল্পনা করে তাদের হারিয়ে দিলাম।”

তুহিন বিস্ময়ে বলল,

চাচা, আপনার ভয় লাগেনি?”

মতিন চাচা উত্তর দিলেন,

ভয় ছিল, তবে দেশপ্রেমের শক্তি আমাদের সাহস দিত। আমরা জানতাম, আমাদের বিজয় আসবেই। কারণ আমরা সঠিকের জন্য লড়ছি।”

তুহিন অনেক কিছু শিখল। সে বুঝল, বিজয় দিবস শুধু ছুটি নয়; এটি আমাদের গর্ব আর ত্যাগের প্রতীক। সেদিন থেকে তুহিন ঠিক করল, সে সবার মাঝে এই গল্পগুলো ছড়িয়ে দেবে।

স্কুলে ফিরে তুহিন তার বন্ধুদের নিয়ে একটি নাটক তৈরি করল। নাটকটির নাম দিল, “মুক্তিযুদ্ধের গল্প”। এতে তারা দেখাল, কিভাবে মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে দেশের জন্য লড়েছিল। নাটকটি দেখে স্কুলের শিক্ষকরা অভিভূত হয়ে গেলেন। প্রধান শিক্ষক বললেন,

তুহিন, তোমরা যা করেছো, তা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার প্রকৃত গল্প পৌঁছে দেবে। বিজয় দিবসের অর্থ এভাবেই ছড়িয়ে পড়তে হবে।”

১৬ ডিসেম্বর জয়পুরের স্কুলে বিজয় দিবস উদযাপনের দিনে তুহিনের নাটক প্রদর্শিত হলো। পুরো গ্রাম এটি দেখতে এলো। নাটক শেষে তুহিন বলল,

আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা আমরা ভুলব না। আমরা তাদের সম্মান করব এবং দেশের জন্য কিছু করার শপথ নেব।”

সেদিন গ্রামে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো। তুহিন আর তার বন্ধুরা ঠিক করল, প্রতিবছর বিজয় দিবসে তারা মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবে, নাটক করবে, এবং সবাইকে দেশপ্রেমের শিক্ষা দেবে।

তুহিনের গল্প আমাদের শেখায়, নতুন প্রজন্মের হাতেই বিজয়ের পতাকা। তারা যদি তাদের দায়িত্ব বুঝতে পারে, তবে দেশ আরও উন্নত ও গর্বিত হবে। বিজয় দিবস তাই শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রেরণাও।

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রাম্প ও বাইডেনের ক্ষমতার পালা বদল : প্রাসঙ্গিক ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধবিজয় দিবস আসবে বলে