অনিয়মে অভ্যস্ত মানুষদের নিয়ম অনুসরণ করাতে গিয়ে ভয়াবহ রকমের সংকট তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। কর্ণফুলী নদীতে শত শত লাইটারেজ জাহাজ অলস বসে থাকলেও অনুমোদিত লাইটারেজ জাহাজের অভাবে বিদেশী মাদার ভ্যাসেলের পণ্য হ্যান্ডলিং বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে। আইন মানার ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নতুন নির্দেশনায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বিশেষ কোনো পক্ষকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্যই আইন বাস্তবায়নে নতুন নির্দেশনা এবং কড়াকড়ি করা হচ্ছে। অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অভ্যস্ত হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে দাবি করে বলেন, বেআইনি কর্মকাণ্ড ঠেকাতেই মূলত আইন মানার নতুন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, বিশ্বের নানা দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। এসব জাহাজের পণ্য বহির্নোঙরে লাইটারেজের মাধ্যমে খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বছরে অন্তত ছয় কোটি টন পণ্য লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে খালাস করা হয়। অবশ্য এসব পণ্যের একটি বড় অংশ সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল।
প্রচলিত নিয়মানুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এবং বন্দরের বিশেষায়িত জেটিতে জাহাজের ওভার সাইডে মালামাল খালাস করার সময় আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্ট কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন করে। কাস্টমস হাউজে আবেদন করার সময় কোন জাহাজে পণ্য খালাস করা হবে তার তালিকা দেওয়া হয়। কাস্টমস হাউজ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটারেজ জাহাজের তালিকা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার প্রত্যায়িত করেন। প্রত্যায়িত লাইটারেজ জাহাজেই শুধুমাত্র মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাসের বিধান রয়েছে। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে প্রচলিত এই নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। মাদার ভ্যাসেল থেকে মালামাল খালাসের ক্ষেত্রে অনুমোদনহীন লাইটারেজ জাহাজ, বার্জ এবং ভলগেটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান ব্যবহার করা হচ্ছে। যেই জাহাজের তালিকা দিয়ে অনুমোদন নেয়া হয় ওই জাহাজ বহির্নোঙরে যায় না। অন্য জাহাজে বা ভলগেটে পণ্য খালাস করা হয়। পরবর্তীতে তালিকা সংশোধন করে নেওয়া হয়। আইন না মানার এই অবস্থায় অনুমোদনহীন এবং অবৈধ জাহাজের চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্দরের ঝুঁকি বেড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গত ১৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সভায় বেআইনি এবং অননুমোদিত লাইটারেজ জাহাজে মালামাল বোঝাই না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এতে প্রথম দফায় গৃহীত অনুমতিপত্রে উল্লেখিত ও বন্দরের হারবার মাস্টার কর্তৃক প্রত্যায়িত লাইটারেজ জাহাজ যথাসময়ে পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে মালামাল খালাসের পূর্বেই লাইটার এবং বার্জের নাম সংশোধন করে নতুন করে অনুমোদন পত্র সংগ্রহের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অননুমোদিত লাইটারেজ জাহাজ বা বার্জে মালামাল খালাস না করার জন্য সকল শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এই নির্দেশ অমান্য করা হলে সংশ্লিষ্ট শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণেরও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।
শিপ হ্যান্ডলিং এসোসিয়েশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, এই নির্দেশনা জারির পর বহির্নোঙরে অননুমোদিত কোনো লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করা হচ্ছে না। আবার অনুমতি নেয়াটাও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় পড়ে। ফলে অনুমোদিত লাইটারেজ জাহাজের অভাবে বহির্নোঙরে বিভিন্ন মাদার ভ্যাসেলে কাজ কর্ম বন্ধ থাকছে। এক একটি জাহাজে চার পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকার ঘটনা ঘটছে।
সূত্র বলেছে, বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল থেকে জাহাজ বরাদ্দ দেয়া হয় সন্ধ্যায়। ওই সময় কাস্টমস এবং বন্দরের অফিস বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বরাদ্দ পাওয়া জাহাজের ব্যাপারে অনুমোদন সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না। আবার অননুমোদিত জাহাজ বহির্নোঙরে পাঠানো যাচ্ছে না। ফলে কাজ-কর্মে সমস্যা হচ্ছে বলে শিপ হ্যান্ডলিং এসোসিয়েশনের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়। তারা বলেন, নতুন নিয়মের ফলে কাজের সমস্যা হচ্ছে। প্রতিদিনই সংকট তীব্র হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের প্রধান নির্বাহী মাহবুব রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়মের। নিয়ম অনুসরণ করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে অভ্যাস হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, অননুমোদিত এবং অবৈধ জাহাজের চলাচল ও দাপট ঠেকাতে এর থেকে ভালো কোনো উদ্যোগ হতেই পারে না। এখন আমরা কোনো জাহাজের কী অবস্থা তা তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারছি। ফিটনেস নেই এমন কোনো জাহাজকে বহির্নোঙরে পাঠানো হচ্ছে না। অবৈধ ভলগেটের চলাচলও বন্ধ হয়ে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, একটি অনিয়ম দিনের পর দিন চলে আসছিল। শুধু অনিয়ম বন্ধ করা হয়েছে। নিয়মে চলাচল করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুচারদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, পরের দিনের জন্য আগের দিন ডব্লিউটিসি থেকে জাহাজ বরাদ্দ নিলে এই সংকট থাকবে না।