বাংলার লোকজ উৎসবের অন্যতম নবান্ন উৎসব। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে অগ্রহায়ণ ও নবান্ন। প্রবাদ আছে–বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ। ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণির সওগাত/ নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাত।’ (অঘ্রাণের সওগাত : কাজী নজরুল ইসলাম)।
হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভায় বিমোহিত কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকম সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। নবান্ন শস্যভিত্তিক একটি লোকউৎসব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করেই এ উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। নবান্নের শব্দগত অর্থ ‘নতুন অন্ন’। একসময় বাংলা মাসই শুরু হতো অগ্রহায়ণ (অগ্র+আয়ন) দিয়ে। কথিত আছে, মোগল শাসনের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে বন্যায় আমন ধান নষ্ট হয়ে গেলে খাজনা আনাদায়ী থাকত। তাই খাজনা আদায় নিশ্চিত করতে পয়লা অগ্রহায়ণের বদলে পয়লা বৈশাখ থেকে খাজনা আদায় করার আইন করা হয়। লোক গবেষক শামসুজ্জামান খানের মতে, ‘মোগল সম্রাটেরা সুবেদার মুর্শিদ কুলি খানের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে প্রচুর পরিমাণে কর আদায়ের নির্দেশ জারি করেন। কৃষিভিত্তিক বাংলায় মোগলদের আচরিত হিজরি সন কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য ছিল প্রতিকূল। কারণ, প্রতিবছর হিজরি সন সাড়ে ১০ বা ১১ দিন পিছিয়ে যায়। এদিক বিবেচনায় রেখে মুর্শিদ কুলি খান আকবর–প্রবর্তিত এলাহি সনের আদলে বাংলায় হিজরি চান্দ্র ও ভারতীয় সূর্য–সনের সম্মিলনে বাংলা সন চালু করেন বলে মনে হয়।’
সমাজ ও সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যকে কেন্দ্র করে উদ্ভব ঘটেছে নানা উৎসব ও আচার–অনুষ্ঠানের। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় খাদ্য আহরণ অর্থনীতির সেই আদিস্তরেও খাদ্য সংগ্রহের সাফল্যে উৎসবের আয়োজন হয়েছে তাদের দলে বা গোষ্ঠীতে। দক্ষিণ ফ্রান্সের ‘টোরেস ফেরেস’ গুহাগাত্রে পাথর খোদাই করে অঙ্কিত হরিণের চামড়া ও শিং পরে নৃত্যরত মানুষের চিত্রসহ আরও অনেক গুহাচিত্র থেকে সমাজ বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন। প্রাচীন মিশর তার ফসল ও উর্বরতার দেবতা মিন’র সম্মানে নবান্ন উৎসব করত। আমেরিকায় ১৬২১ সালে প্রথম অভিযাত্রীদল প্রচুর পরিমাণ ফসল উৎপাদন করে। এর মধ্যে ছিল গম, সবজি, ফল। এমনকি প্রচুর মাছও। সে বছর থেকেই তাদের গভর্নর উইলিয়াম ব্রাডফোর্ড সবাইকে নিয়ে নবান্ন উৎসব শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ১৭৭০ সালে জাতীয় কংগ্রেস রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি পালন করে। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এই উৎসবের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করেন। কানাডা আমেরিকার আদলে নবান্ন উৎসব বা ফসলের উৎসব পালন করে ১৮৭৯ সাল থেকে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন নামে বা ধরনে নবান্ন পালিত হয়। রাশিয়ায় নবান্নকে বলা হয় রদুনিৎসা। এছাড়া ইরান, জাপান, এমনকি ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ও ধরনে নবান্ন উদযাপন করা হয় ।
আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, হয়ত মানুষ নয় হয়ত শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।
শুধু ধান কাটা নয়, ভোরে দেখা যায় ঘাষের ডগায় শিশির বিন্দু। মানে শীত এসেছে। নতুন ধানের সৌরভ আর হিমশীতল হাওয়া প্রকৃতি সাজে ভিন্নরূপে, এনে দেয় অন্যরকম দ্যোতনার। নবান্ন উপলক্ষে গ্রামে ঘরের দাওয়ায়, বাড়ির উঠোনে চলে নবান্নের গান, লোকগীতি, লালন গীতি, বাউলগান, সাপখেলা, বানরখেলা, লাঠিখেলা ইত্যাদি বাংলার প্রাচীন সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। ছোটদের বাড়তি আনন্দ দিতে গ্রাম্য মেলা। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি–ধর্ম–বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে।
চারদিকে নতুন ধানের মৌ মৌ সুগন্ধে গ্রামে পিঠা–পুলি বানানোর ধুম লেগে যায়। নতুন চালে পিঠার মজাই যেন আলাদা। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধচিতই, ছিট পিঠা, দুধকুলি, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি, পাটিসাপটা, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, ঝাল পিঠা নবান্ন উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে অনেকে এই পিঠা–পুলির স্বাদ নিতে গ্রামে ছুটে যান।