নবম ও নতুন জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতোপূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশসহ (হুজিবি) বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দেশের প্রায় সব জঙ্গি সংগঠন সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে আগেই। ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম চালাতে নতুন প্ল্যাটফর্ম খুঁজছিল। এ কারণেই নতুন নাম দিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গিরা। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে সংগঠনটির বেশ কিছু সদস্য। ছদ্মবেশে সংগঠিত হচ্ছিল তারা।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, দেশের কয়েকটি জেলা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি আমরা জানতে পারি, তারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি ছেড়েছে। যারা অধিকাংশই নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ায় যুক্ত। এই সংগঠনের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই আমরা। নিরুদ্দেশ হওয়া ৩৮ জনের অধিকাংশই পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ছত্রচ্ছায়ায় আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের কার্যক্রম চালাচ্ছে। সংগঠনটিকে নিষিদ্ধের জন্য আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করবো। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ করবে।
সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করতে সুপারিশপত্র পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এরপর মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।
জানা গেছে, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কর্মকাণ্ডের সাথে পূর্বেকার জঙ্গি সংগঠনগুলোর যেমন কিছু মিল রয়েছে, তেমনি অমিলও রয়েছে প্রচুর। অতীতে সংগঠিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর ভাবধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা নিজেদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং দেশের নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে নয়, একাধিক অঞ্চলে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তারা সংগঠনের প্রতি অনুপ্রাণিত তরুণদের। সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া হিসেবে সংগঠনের কার্যক্রম, উদ্দেশ্য ও সদস্যসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে নথি যাওয়ার পরে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিষিদ্ধ তিন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের কিছু নেতার উদ্যোগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া (যার বাংলা অর্থ: পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল) গঠন করা হয়। ২০১৭ সালে এরা সংগঠিত হতে শুরু করলেও সংগঠনের নাম ঠিক করে ২০১৯ সালে। অতীতেও দেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন পাহাড়ে আস্তানা বা ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করেছিল। কেউ জমি কিনে, কেউ ছোটখাটো মাদ্রাসা স্থাপন করে চেষ্টাটি করে। আবার কখনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের (এনজিও) আড়ালে সে চেষ্টা হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর আস্তানায় ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার এমন খবর আগে জানা যায়নি। অতীতে জঙ্গি সংগঠনগুলো সমআদর্শের লোকজনের সহায়তা নিলেও এ সংগঠনটি ভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছে। বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন নিয়ে গঠিত কেএনএফ সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সহযোগিতা করছে জামাতুল আনসারকে।
নতুন জঙ্গি সংগঠন নিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণে থাকা জামাতুল আনসারের সদস্য সংখ্যা ৫০ এর বেশি। সংগঠনটির আমিরের নাম মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ। উগ্রবাদী এ সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্য রয়েছেন। তারা অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গোপনে পরিচালনার জন্য বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকাকে বেছে নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করত। জামাতুল আনসার তাদের বাছাই করা তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের হেফাজতে রাখে। যেসব বাড়িতে রাখা হয়, সেটাকে তারা ‘আনসার হাউস’ (সাহায্যকারীর বাড়ি) বলে। এরপর চরাঞ্চলে শারীরিক কসরতসহ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে উত্তীর্ণদের প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানে কেএনএফের ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় কাজ করে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপর একটি সূত্র বলছে, তাঁদের ধারণা, নতুন করে জঙ্গি তৎপরতার যে খবর এখন জানা যাচ্ছে, এই তৎপরতা আরও কয়েক বছর আগেই শুরু হয়েছে। কারণ, কয়েক বছর আগে হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন সংগঠনের গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। বিশেষ করে কেএনএফের সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সংযোগ স্থাপন করে দিয়েছেন বলে যাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে, তিনি হলেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বহিষ্কৃত শিক্ষক শামিন মাহফুজ ওরফে শামিন স্যার ওরফে মেন্ডিং মুরং। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি। পলাতক শামিনকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃক্সখলা বাহিনী। জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে দু’বার গ্রেপ্তার হন শামিন। সবশেষ গ্রেপ্তার হন ২০১৪ সালে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ২০১৭ সালে জামিনে বের হওয়ার পর থেকেই লাপাত্তা। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন থেকে সদস্য এনে নতুন জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে শামিনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। কারাগারে থাকার সময়ই শামিনের সঙ্গে রক্সি এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হরকাতুল জিহাদ নেতা আবু সাঈদের পরিচয় হয়। সেখানেই তারা নতুন জঙ্গি দল গড়ার পরিকল্পনা করেন। ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর রক্সি ও শামিন মাহফুজ মিলে সেই দল গঠনের কাজ শুরু করেন।
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন হিসেবে আটটি সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়। সবশেষ ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয় জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দল’। এর আগে ২০১৭ সালের ১ মার্চ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে ‘আনসার আল ইসলাম’ নিষিদ্ধ করে সরকার। জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকায় ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহাদত-ই-আল হিকমা, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ও জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীর এবং ২০১৫ সালের ২৫ মে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করা হয়।