১১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়িয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নতুন খাল খনন প্রকল্প দ্বিতীয় দফায় সংশোধনের প্রস্তাব যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে। নতুন প্রস্তাবিত ব্যয় এক হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। সংশোধিত প্রকল্পে সম্পূর্ণ ব্যয় ধরা হয়েছে জিওবি ফান্ড বা সরকারি সহায়তায়। যদিও ২৫ শতাংশ অর্থ চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয়ের শর্তে ছয় বছর আগে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। আজ মঙ্গলবার সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের কথা রয়েছে। এতে সংশোধনের পাঁচটি কারণ এবং সম্পূর্ণ অর্থ সরকারি ফান্ড থেকে চাওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি নগরীর ওয়াইজ পাড়া এলাকায় স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল প্রকল্পটির। গতকাল বিকেলে সে একই জায়গায় উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের কোন অগ্রগতিই হয়নি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উদ্বোধনের পর কোন কাজ হয়নি। এ বিষয়ে চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়া প্রকল্পের উদ্বোধনই বা হলো কেন? এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে ৬ জন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়া এ ঠিকাদার নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে অনেকে।
চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৪ জুন ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ চার হাজার টাকায় নতুন খাল খনন প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছিল। পরবর্তীতে কাঙ্খিত বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি চসিক। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর প্রথমবার সংশোধন করে প্রকল্পটি ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় একনেক। ইতোমধ্যে প্রকল্পের জিওবি সহায়তা হিসেবে দুই কিস্তিতে সরকার থেকে ৯১৪ কোটি কোটি ৮৭ লাখ টাকা পেয়েছে চসিক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রধান অংশ ২৫ দশমিক ১৬৬৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ। সম্ভাব্য ভূমিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে পৃথক পাঁচটি মামলা হয়েছে জেলা প্রশাসনের এল এ শাখায়। বিপরীতে দুই ভাগে ১০ দশমিক ৮৫১ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ কমিটি।
এদিকে অনুমোদিত ভূমি এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৪টি অংশে ভাগ করে গত বছর দরপত্র আহবান করে চসিক। এর মধ্যে ৬টি অংশে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ কেন্দ্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ কমিটি অনুমোদন দিলেও তা অধিগ্রহণ করে সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেয়নি জেলা প্রশাসন। এমনকি ভূমি মালিকরা ক্ষতিপূরণও পান নি। তাই অধিগ্রহণ ছাড়াই ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রকল্পটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমেদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, এল এ মামলা জিতলেও জেলা প্রশাসন থেকে আমাদের এখনো জায়গা বুঝিয়ে দেয়নি। তাই কাজ করা যাচ্ছে না। প্রকল্প পরিচালক জেলা প্রশাসনের সাথে মিটিংও করেছে। তাদেরকে চিঠি দেয়া হয়েছে, মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণ বা জায়গা বুঝে পাওয়ার আগেই প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেখানে কাজ শুরু করা যায় সেখানে করবো এই ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। যেহেতু এল এ মামলা জিতেছে তাই আমরা ভাবছিলাম জায়গা বুঝিয়ে দিবে। তাছাড়া আমরা টাকাও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম জেলা প্রশাসনকে। পরবর্তীতে তারা জায়গা বুঝিয়ে না দেয়ায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। আবার এলাকার লোকজন বা যাদের জমি যাবে তারা টাকা (ক্ষতিপূরণ) না পেলে তো কাজ করতে দিচ্ছে না। তারা আশ্বাসের উপর তো জায়গা দিতে চাচ্ছে না।
প্রকল্পটির একটি অংশের ঠিকাদার মো. হেলাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় আমরা কাজ করতে পারছি না। তাছাড়া টেন্ডারের সাথে বর্তমান পরিস্থিতির সামঞ্জস্য নেই। তাই প্রকল্পটি সংশোধন করা হবে।
পাঁচ কারণে সংশোধন :
প্রকল্পটি ২য় বার সংশোধনে পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে প্রস্তাবিত ডিপিপিতে। এর মধ্যে প্রথম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রথম সংশোধনীতে ১৬ কোটি টাকায় একটি স্লুইস গেইট নির্ধারিত ছিল। কিন্তু চলমান পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পে স্লুইস গেইটটি অন্তর্ভুক্ত থাকায় এখন তা বাদ দিতে হবে।
২য় কারণ হচ্ছে- প্রথম সংশোধনীতে ৫ হাজার ৮০০ মিটার রাস্তা নির্মাণে ৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারিত ছিল। বর্তমানে সিডিউল রেইট বৃদ্ধি পাওয়ায় ও কনসালটেন্ট কর্তৃক সার্ভে থেকে প্রাপ্ত ডিজাইন অনুযায়ী সড়ক নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে আকার হচ্ছে ২৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
৩য় কারণ হচ্ছে- অনুমোদিত প্রকল্পে ৬টি ব্রিজের ব্যয় ধরা হয় ১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু বর্তমানে প্রস্তাবিত খালের এলাইনমেন্টে ৩টি নতুন সংযোগ সড়কের সৃষ্টি হয় এবং সেখানে ৯টি ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আবার ‘হাই ফ্ল্যাড লেবেল’ বিবেচনায় এসব ব্রিজের উচ্চতা বাড়াতে হবে। এতে ব্যয় বেড়ে হবে ৪১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
৪র্থ কারণ হচ্ছে- অনুমোদিত প্রকল্পে ৫ হাজার ৫০০ মিটার প্রতিরোধ দেয়ালের জন্য ৩৬ কোটি টাকা ধরা হয়। বর্তমানে সিডিউল রেট ও কনসালটেন্টের ডিজাইন অনুযায়ী তা বেড়ে হবে ৯২ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
৫ম কারণ হচ্ছে- অনুমোদিত প্রকল্পে ২ হাজার ৯০০ মিটার ড্রেইন নির্মাণের বরাদ্দ ছিল। বর্তমানে খালের উভয় পাড়ের রাস্তার পাবলিক সাইডে ড্রেইন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এতে ড্রেনের দৈর্ঘ্য বেড়ে হবে ৫ হাজার ৫০০ মিটার, নির্মাণ ব্যয় ৩৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
এছাড়া প্রকল্পের ব্যয় সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে করার কারণ হিসেবে ২য় সংশোধনের প্রস্তাবিত ডিপিপিতে বলা হয়, অনুমোদিত ডিপিপিতে ভূমি অধিগ্রহণ এবং ভবন ক্ষতিপূরণ বাবদ এক হাজার ১১৮ কোটি ৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা নির্ধারিত ছিল। ইতোমধ্যে জিওবি ফান্ডের ছাড় হওয়া অর্থ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৯১১ কোটি ২৫ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পের ২৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না সিটি কর্পোরেশনের। এমনকি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার অবশিষ্ট ব্যয় ভারও নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। তই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের স্বার্থে শতভাগ অর্থায়ন সহায়তা প্রদান জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়।
উল্লেখ্য, বারইপাড়াস্থ চাক্তাই খাল থেকে শুরু করে শাহ্ আমানত রোড হয়ে নুর নগর হাউজিং সোসাইটির মাইজপাড়া, পূর্ব বাকলিয়া বলির হাটের পাশে জানালী বাপের মসজিদ হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়বে নতুন খালটি। খালটির দৈর্ঘ্য হবে ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার এবং প্রস্ত হবে ৬৫ ফুট।