নগরীর মোহাম্মদপুর এলাকায় দুইশ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ‘বড় পুকুর’টি ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। ১০ কানির পুকুরটি এখন তিন কানিতে এসে ঠেকেছে। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেখে মনে হতে পারে পরিত্যক্ত কোনো ডোবা। চারদিকে আবর্জনা আর কচুরিপানা। দুর্গন্ধময় পানি আর নোংরা পরিবেশ। চারদিকে ঘেরা দেওয়া; বোঝার উপায় নেই স্বচ্ছ টলটলে পানির বিশাল একটি পুকুর। ইতোমধ্যে পুকুরের বেশকিছু অংশ ভরাট করে পাকা এবং সেমিপাকা ঘর ও দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি অংশও নানান কৌশলে রাতের আঁধারে ভরাট করা হচ্ছে। এমন করুণ অবস্থা দেখা গেছে নগরীর প্রাণকেন্দ্র মোহাম্মদপুর এলাকায় ২শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ‘মোহাম্মদপুর বড় পুকুরের’। জানা গেছে, পুকুরটির অবস্থান ছিল প্রায় ১০ কানি অংশ জুড়ে। এখন ভরাট হতে হতে ৩ কানিতে এসে ঠেকেছে। ১৯৮৫ সালে পুকুরটি পুনঃখনন করা হয়েছিল। ২০১৬ সাল থেকে পুকুরের মালিকদের একটি পক্ষ পুকুরটি ভরাট করতে শুরু করে। বছরের পর বছর সংস্কারের অভাবে বিদ্যমান পুকুরে কচুরিপানা, ঘাস–লতাপাতায় ভরে গেলেও এখনো ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীরতা রয়েছে এই পুকুরের।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মালেকের বক্তব্য আজাদীর প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর বড় পুকুর ভরাটের ব্যাপারে আমরা একাধিকবার অভিযান করেছি। এখন আবার কেউ ভরাট করছে কিনা আমি আবার খোঁজ নিচ্ছি। যদি কেউ ভরাট করার চেষ্টা করে তাহলে আবার অভিযান চালানো হবে। পুকুরের আবর্জনা আর কচুরিপানা পরিষ্কার করে পুকুরটি ব্যবহার উপযোগী করার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এটা সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগ নিবে। স্থানীয় কাউন্সিলরকে আমরা এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার জন্য বলবো। পুকুরটি যাতে আর কেউ ভরাট করতে না পারে–প্রকৃত জলাধার ফিরে পায়–সেই ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নেবো’। পুকুরের অনেক মালিকের খতিয়ান সৃজনের সময় স্থানীয় ভূমি অফিসে এটাকে ভিটে ভূমি হিসেবে উল্লেখ করায় ভূমি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি।’
পুকুর, খাল, নদী–এসব জলাশয় নগরের প্রাণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পুকুর ও জলাশয় না থাকলে নগরের তাপমাত্রা শুধু বৃদ্ধি পায় না, নগরে পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। কিন্তু সেই পুকুর ও জলাশয়গুলোকে কিছুতেই রক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই জলাশয় রক্ষায় বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান জরুরি। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জলাশয় সংরক্ষণ আইনসহ অনেকগুলো আইন কোনো না কোনোভাবে জলাশয় দূষণ ও দখল প্রতিরোধ, সংরক্ষণ ও রক্ষা বা এ সম্পর্কিত বিষয় উল্লেখ করেছে। কিন্তু এসব আইন বাস্তবায়নও কোনো একক সংস্থার কাছে না থাকায় আইনের বাস্তবায়ন শিথিলভাবে হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোন বাস্তবায়নই হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া দখল ও দূষণকারীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শ আইন বাস্তবায়নে বাধার সম্মুখীন হয়।
যারা পুকুর, দিঘি ও জলাশয়গুলো ভরাট কিংবা দখল করেছেন ও করছেন, তাদের বেশিরভাগই আসলে লোভ ও লালসা থেকেই করছেন। ফলে পুকুর ভরাটের ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে বেআইনিভাবে এবং কখনো কখনো যোগসাজশে আইনের ফাঁক গলিয়ে। এসব ক্ষেত্রে আইন রক্ষার দায়িত্ব যে সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সে সকল প্রতিষ্ঠানকেও আমরা যথাযথ দায়িত্ব পালনে দেখছি না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রকৃতি প্রদত্ত কিংবা মানুষের সৃষ্টি করা বৈশিষ্ট্যসম্বলিত ও পুরনো পুকুর, দিঘি এবং জলাশয়গুলোকেই বেশি নষ্ট করা হচ্ছে, ভরাট ও দখল করা হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জরুরি। উন্নয়ন মানে পরিবেশ ধ্বংস নয়, এ ভাবনা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুধু তাৎক্ষণিকভাবে লাভবান হবার জন্যই এসব পুকুর জলাশয় ভরাট করে দখল ও ভবন নির্মাণ চলছে। এ প্রবণতা বন্ধ করা দরকার। এ ব্যাপারে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে সমন্বয় সাধন করতে হবে। বিশেষ করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনকে সমন্বয়ের মাধ্যমে পুকুর, দিঘি ও জলাশয় রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে।