ঋত্বিক নয়ন ম পূজার মার্কেটে কিংবা গণপরিবহনে অথবা রিকশায় যাওয়ার পথে টানা পার্টি বা ছিনতাই চক্রের খপ্পরে পড়ে খোয়াচ্ছেন স্মার্ট ফোন, মানিব্যাগ, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস। সাধারণ মানুষ বলছেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। কিন্তু পুলিশ বলছে, কম। ভুক্তভোগী ও যাত্রীরা জানান, প্রায়ই দেখা যায়, গণপরিবহনে যাত্রী ওঠার সময় গেটের সামনে একটা অহেতুক ভিড়। যাত্রীদের দুই পাশ থেকে ধাক্কাধাক্কি ও চাপাচাপির পর আবার স্বাভাবিক। মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন গায়েব করার জন্য ওই ভিড় সৃষ্টি করে টানা পার্টির সদস্যরা। ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও খোয়া যাওয়া বা ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন খুব কমই উদ্ধার হয়। এ বিষয়ে থানা পুলিশও খুব বেশি তৎপরতা দেখায় না।
সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেছেন, বর্তমানে নগরীতে টানা পার্টির দৌরাত্ম্য ও ছিনতাই তৎপরতা অনেকটাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি রয়েছে। প্রায় সময় টানা পার্টি ও ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা এসআই রবিউল জানান, এলাকা, পাড়া–মহল্লা বা রাস্তার পাশে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকে টানা পার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা। এদের কোনো ঘর বাড়ি নেই। এলাকাভিত্তিক এসব চক্রের স্থানীয় কিছু লিডার থাকে। যারা তাদের বিভিন্ন সময় শেল্টার দিয়ে থাকে। সুযোগ বুঝে তারা ছিনতাই কর্ম চালায়।
নগরীর অন্তত ৫০টি স্পটে এসব ছিঁচকে ঝাপটাবাজদের উৎপাত চলছে। নগরীর ব্যস্ততম নিউমার্কেট মোড়, তিনপোলের মাথা, নতুন স্টেশনের মুখ, পুরাতন স্টেশনের গ্রামীণ মাঠ, রেয়াজউদ্দিন বাজারের মেইন গেট, স্টেশন রোড, টাইগারপাস, দেওয়ানহাট মোড়, আগ্রাবাদ–বাদামতলী মোড়, ইপিজেড, জিইসি মোড়, মুরাদপুর, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব ঝাপটাবাজদের তৎপরতা দেখা যায়। ঝাপটাবাজদের পাশাপাশি নগরীর গণপরিবহনগুলোতে পকেটমারের উৎপাতও বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই লোকজন গণপরিবহনে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ হারাচ্ছেন। নগরীর বিভিন্ন স্পটে গণপরিবহনের যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। আবার সন্ধ্যার পরে পূজার মার্কেটে এসব টানাপার্টির উৎপাত বেড়ে যায়। বড় ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় মামলা হলেও ছোটখাটো ছিনতাই ও ঝাপটাবাজির ঘটনায় থানায় মামলা হয় না।
কেন মোবাইল উদ্ধার করা যাচ্ছে না? : প্রতিদিন শুধু নগরী থেকেই কি পরিমাণ মোবাইল চুরি কিংবা ছিনতাই হচ্ছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কারণ সব ক্ষেত্রেই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা অভিযোগ করেন না ভুক্তভোগী। অনেক ক্ষেত্রে জিডি হওয়ার পরও মোবাইল উদ্ধার করতে পারছে না পুলিশ। কিন্তু কেন এসব মোবাইল উদ্ধার করা যাচ্ছে না? পুলিশ জানিয়েছে, আইএমইআই পরিবর্তন করতে চক্রটি তৈরি করেছে একটি ল্যাব। অবৈধভাবে আমদানি করেছে কিছু ডিভাইস। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তারা একটি মোবাইল হ্যান্ডসেটের আইএমইআইটি বদলে ফেলছে। পরে বিক্রি করছে বাজারে। তারা এখন নতুন প্রযুক্তি মাইক্রোস্কোপ, একটি সিপিইউ, দুইটা ল্যাপটপ, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নিয়ে একটি ল্যাব বানিয়েছে। ওই ল্যাবে নিয়ে তারা মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেয়। তারা গ্যারান্টি দেয় যে এটা চোরাই মোবাইল হলেও কেউ ধরতে পারবে না।
তিনটি গ্রুপে ৬০ পকেটমার : তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কমপক্ষে ৬০ জন পেশাদার পকেটমার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরী। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর নগরীর বিভিন্ন রুটের বাসে উঠে ভিড়ের মধ্যে এরা হাতিয়ে নিচ্ছে মোবাইল–মানিব্যাগ। তিনটি গ্রুপের মূল নেতা হচ্ছে সাহাবুদ্দিন, ফারুক এবং জাহেদুল ইসলাম প্রকাশ লিটন। এদের গডফাদার হিসেবে আছে ঢাকার জামাল ওরফে পিচ্চি জামাল নামে একজন। পিচ্চি জামালের হয়ে চট্টগ্রামে এসব পকেটমারদের দলনেতাদের নিয়ন্ত্রণ করে জাহেদ ওরফে ঘাড় বাঁকা জাহেদ। তার বাড়ি বাকলিয়ার ইছাইক্যারপুলে, তবে ঢাকার বাড্ডায় থাকে। পিচ্চি জামাল কখনও চট্টগ্রামে আসে না। জাহেদ প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শুক্রবার সকালে পৌঁছায়। বিকেলে রেলস্টেশনে গিয়ে ফারুক, সাহাবুদ্দিন, লিটনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতি সপ্তাহে জাহেদ চট্টগ্রাম থেকে ৫০–৬০ হাজার টাকা করে নিয়ে যায়। পকেটমারদের কেউ গ্রেপ্তার হলে জামাল ও জাহেদ মিলে জামিনসহ ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিকেল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত হচ্ছে এদের কাজের সময়। এরা এসময় ফ্রিপোর্ট থেকে দেওয়ানহাট এবং নিউমার্কেট এলাকার বাসে উঠে পড়ে। ভিড়ের মধ্যে মোবাইল এবং মানিব্যাগ পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়। এক বাসে তারা ৭–৮ জন একসঙ্গে উঠে। একজন যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে জটলার সৃষ্টি করে। আরেকজন পকেটের নিচ থেকে হালকাভাবে ঘষতে ঘষতে মোবাইলটি উপরের দিকে নিয়ে আসে। তারপর হুট করে নিয়ে পাশে থাকা আরেকজনকে দিয়ে দেয়। সে আরেকজনকে দেয়। এভাবে মোবাইলটি পার হয়ে যায়। এসময় যদি কেউ ধরা পড়ে, তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তিন–চারজন কাজ করে।