স্বনামধন্য আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান র্যাংকস এফসি প্রোপার্টিজ সম্প্রতি র্যানকন এফসি প্রোপার্টিজ নামে যাত্রা শুরু করেছে। নাম পরিবর্তনের কারণ, গ্রিন বিল্ডিং নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি ও সরকারের পলিসি সাপোর্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে দৈনিক আজাদীর সাথে কথা বলেছেন র্যানকন এফসি প্রোপার্টিজের প্রধান নির্বাহী (সিইও) তানভীর শাহরিয়ার রিমন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আজাদীর স্টাফ রিপোর্টার জাহেদুল কবির।
দৈনিক আজাদী : আপনারা দীর্ঘদিন ধরে আবাসন ব্যবসায় সুনামের সাথে কাজ করছেন। সম্প্রতি আপনাদের প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হয়ে র্যাংকস এসফি প্রোপার্টিজ থেকে র্যানকন এফসি প্রোপার্টিজ হয়েছে। নাম পরিবর্তনের কারণ কি?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন : আমরা র্যানকন গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। আপনারা জানেন, র্যানকন এখন দেশের শীর্ষ গ্রুপগুলোর একটি। রিয়েল এস্টেট, সি ফিশিং, শিপ বিল্ডিং, অটোমোবাইলস, লুব্রিকেন্ট, ইলেকট্রনিঙ, আইটি, ফ্যাসিলিটি ম্যানেজমেন্ট, আইএসপি, ইপিসি, ব্যাংক, বিমাসহ নানা খাতে এই গ্রুপের বিনিয়োগ আছে। ৩৫টি কোম্পানি আছে এই গ্রুপের অধীনে। দেশের সফল উদ্যেক্তা রোমো রউফ চৌধুরী আমাদের গ্রুপ চেয়ারম্যান। আমাদের গ্রুপের সাথে আরো বেশি স্ট্র্যাটেজিক অ্যালাইনমেন্টের জন্য এই নাম পরিবর্তন। প্রকৃতপক্ষে কৌশলগত নাম পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ হয়নি। একই বোর্ড, একই ম্যানেজমেন্ট, একই টিম, একই ভিশন। আমাদের যারা স্টেকহোল্ডার, গ্রাহক, ভূমি মালিক, ভ্যালু চেইন পার্টনার আছেন; নাম পরিবর্তনের বিষয়টা সবাই ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। অতীতে বহু প্রতিষ্ঠানে এ রকম নাম পরিবর্তন হয়েছে, যেমন একটেল থেকে রবি, লিভার ব্রাদার্স থেকে ইউনিলিভার।
আজাদী : গ্রিন ভবন তৈরিতে আপনাদের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন : গ্রিন ভবন তৈরিতে আমাদের প্রতিষ্ঠান অনেক দিন ধরে কাজ করছে। বলা যায়, চট্টগ্রামে আমরাই প্রথম গ্রিন বিল্ডিং বা পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণ শুরু করেছি। এর মধ্যে অনেকগুলো গ্রিন প্রকল্প হস্তান্তরও করেছি। যার মধ্যে মেমোরি সেভেন্টিওয়ান, হোয়াইট ওক, পার্ক ট্যারেস উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে গ্রিন বিল্ডিং বা সবুজ স্থাপনা সাধারণভাবে প্রচলিত কোনো প্রত্যয় নয়, এটি একটি মুভমেন্ট বা আন্দোলনের নাম। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পৃথিবীকে টেকসই করতে পরিবেশ থেকে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে এই মুভমেন্ট। একটি দালান বা ভবনকে সবুজ দিয়ে রং করে দিলেই সেটি যেমন গ্রিন বিল্ডিং হয়ে উঠে না, সেটিতে কিছু গাছ লাগিয়ে দিলেই সেটি পরিবেশবান্ধব হয়ে যায় না। গ্রিন বিল্ডিং হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, ভবনের কাজে ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রীগুলোকে অবশ্যই কম কার্বন নিঃসরণকারী তথা পরিবেশবান্ধব হতে হবে। বর্তমানে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত প্রচলিত ইটসমূহ ইটভাটায় টপ সয়েল পুড়িয়ে প্রস্তুত হয়, যা একদিক কৃষিজ জমি হ্রাস করছে, তেমনি ইটভাটার কয়লা নিঃসৃত কালো ধোঁয়া কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনছে। আমাদের দেশে দিন দিন উষ্ণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা ভূমিকা রাখছে। একটি সবুজ নগরী গড়ে তোলার স্বার্থে ভবনের নির্মাণ কাজে ইটের পরিবর্তে অ্যারিয়েটেড অটোক্ল্যাভ কনক্রিটের ব্যবহার করতে হবে। এই ব্লক তৈরিতে পরিবেশের ক্ষতিকর কোনো উপাদান ব্যবহৃত হয় না। এটি প্রথাগত ইটের চেয়ে তিন গুণ হালকা। এটি ভবনের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া নবায়নযোগ্য সৌরশক্তির ব্যবহার, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, এনার্জি এফিসিয়েন্ট উইন্ডো, ভার্টিক্যাল গ্রিন ওয়াল নির্মাণ, ওয়েস্ট রিডাকশনের বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। আমাদের নির্মাণে আমরা এই বিষয়গুলো শতভাগ নিশ্চিত করছি। আমাদের নির্মিত ভবনের তাপমাত্রা সবসময় ২/৩ ডিগ্রি কম থাকছে। ভবিষ্যতে আমরা নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার আরো বাড়াতে চাই। রিসাইক্লিংযোগ্য নির্মাণ সামগ্রীর অধিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই। টঙিক ম্যাটেরিয়াল বর্জন করার পাশাপাশি সব রকম অপচয় কমাতে চাই। যতটা সম্ভব কার্বন অফসেট করাই আমাদের লক্ষ্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শহরকে বাসযোগ্য রাখতে এবং টেকসই রাখতে আমরা কাজ করতে চাই।
আজাদী : বর্তমানে আপনাদের প্রকল্পের সংখ্যা কত? কী ধরনের প্রকল্প নির্মাণ করছেন?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন : আমাদের চলমান প্রকল্পের সংখ্যা ২৩টি। মূলত কমার্শিয়াল এবং আবাসিক দুই ধরনের প্রকল্প করছি। শেখ মুজিব রোড, পাঁচলাইশ আবাসিক, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, নাসিরাবাদ প্রোপার্টিজ, খুলশী আবাসিক, দক্ষিণ খুলশী, মেহেদীবাগ, শহীদ মির্জা লেন, পূর্ব নাসিরাবাদ, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় আমাদের প্রকল্প চলমান।
আজাদী : বর্তমানে নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের জন্য আপনারা কোনো পরিকল্পনা করেছেন?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন : বিগত দুই বছর নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, পাথর সবগুলোর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি লিফট ও জেনারেটরের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। টাইলস, সেনিটারি ও ইলেকট্রিক ক্যাবলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্লাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানিতে বড় রকমের ইনফ্লেশন হয়েছে। সামনে আমদানি–নির্ভরতা কীভাবে কমানো যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন এককভাবে কোনো আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে পারবে না। এগুলোর পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ দরকার। আপনি দেখেন, চট্টগ্রামে রেলওয়ের অনেক পরিত্যক্ত জমি দখল–বেদখল হয়ে আছে। এগুলোকে যদি টেন্ডারের মাধ্যমে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়, তবে মধ্যবিত্তের জন্য স্বল্পমূল্যের ফ্ল্যাট বানাতে পারত। কারণ জমির দাম কম হলে ফ্ল্যাটের দাম কমবে। অন্যদিকে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, আমরা ধীরে ধীরে উপশহরগুলোতে যাব। সেটি স্যাটেলাইট টাউনশিপ হতে পারে। এসব উপশহর এলাকায় জমির দাম কম। আশা করি, পলিসি সাপোর্ট পেলে ২–৩ বছরের মধ্যে মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন প্রকল্প নিয়ে আসতে পারব। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অ্যাপার্টমেন্টের সাইজ ছোট করে নিয়ে আসা। বিদেশে, বিশেষ করে সিঙ্গাপুর কিংবা হংকংয়ে খুব বড় অ্যাপার্টমেন্ট কিন্তু হয় না। সেগুলো হয় ৬শ থেকে ৮শ স্কয়ার ফিটের। আমাদেরকেও ধীরে ধীরে ১/২ শয়ন কক্ষের ফ্ল্যাটে অভ্যস্থ হতে হবে। আমরা এ রকম কিছুর পরিকল্পনাও করছি।
আজাদী : সরকারের কাছ থেকে আপনারা কেমন পৃষ্ঠপোষকতা চান?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন : নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চ মূল্য কমাতে পলিসি সাপোর্ট দিতে হবে। প্রয়োজনে ডিউটি, ভ্যাট, ট্যাঙ পলিসি রিভিউ করা যেতে পারে। রাজস্ব বাড়ানোর বহু উপায় আছে। উচ্চ নিবন্ধন ফি’র জন্য হাজার হাজার অনিবন্ধিত ফ্ল্যাট পড়ে আছে। নিবন্ধন ফি অর্ধেক করে দিলে কত টাকা রাজস্ব আদায় হবে, এটা ভেবে দেখা দরকার। এছাড়া গ্রিন বিল্ডিং নির্মাণে আপফ্রন্ট খরচ এখন বেশি। গ্রিন বিল্ডিং যারা বানাবেন তাদের যদি ট্যাঙে বেনিফিট দেওয়া হয়, সিটি কর্পোরেশন যদি ভবনের হোল্ডিং ট্যাঙ কমিয়ে দেয় তাহলে অনেকেই উৎসাহিত হবেন। নগর আমাদের সবার। সবাইকে নিয়ে এই নগরকে টেকসই করতে হবে।