চট্টগ্রামে নাগরিকদের বিশেষ করে শিশুদের মানসিক বিকাশে উন্মুক্ত পরিবেশে ঘোরাঘুরি ও বিনোদনকেন্দ্রগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে সাধারণ মানুষের ঘোরাঘুরির জন্য তেমন স্থান অপ্রতুল। বিশেষ করে নগরের শিশুদের ছুটির দিনে ঘুরে বেড়ানোর মতো পার্ক আর নেই। জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের হিসাবে, চট্টগ্রাম নগরে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। এর মধ্যে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা সাড়ে ৫ লাখের বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি এক হাজার জন বাসিন্দাদের জন্য অন্তত তিন একর খেলার মাঠ কিংবা পার্ক প্রয়োজন। সে হিসাবে শিশুদের জন্য যে পরিমাণ মাঠ কিংবা পার্ক চট্টগ্রামে থাকার কথা, তার কিছুই নেই।
এ অবস্থায় ৩ আগস্ট দৈনিক আজাদীতে ‘চাক্তাই–কালুরঘাট রিং রোডে হচ্ছে বিনোদন কেন্দ্র’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদটি নগরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সংবাদে বলা হয়, নান্দনিক পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের আদলে চাক্তাই–কালুরঘাট আউটার রিং রোড প্রকল্পে কর্ণফুলীর তীরঘেঁষে গড়ে উঠছে নতুন বিনোদন কেন্দ্র ‘কর্ণফুলী রিভারভিউ পার্ক’। চাক্তাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত রিং রোড হচ্ছে, যা উপকূলীয় বেড়িবাঁধ হিসেবে কাজ করবে। প্রকল্পটির পুরোপুরি কাজ শেষ হওয়ার আগেই কল্পলোক আবাসিকের পেছনের অংশে কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষে এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বেড়িবাঁধ, ব্লক নির্মাণের ফলে কর্ণফুলীর অপার সৌন্দর্য এখানে দাঁড়িয়ে এবং বসে উপভোগ করা যায়। নদীর পারে নির্মিত বেড়িবাঁধ ও ব্লকগুলো এখানকার সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ করে তুলেছে। দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্থানটি। বিকেল হলেই নদীর পারে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও প্রিয়জনকে নিয়ে সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসছেন পর্যটকরা। নগর রক্ষার পাশাপাশি এটি এখন চট্টগ্রামবাসীর কাছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। এখনো পরিপূর্ণভাবে সকল কাজ শেষ না হলেও প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ, কর্ণফুলীর স্নিগ্ধতা, গতিময়তা ও মাধুর্যের সবটাই দেখা যায় এখান থেকে। বিশেষ করে সরকারি ছুটির দিনে নতুন এই বিনোদন কেন্দ্রটি লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই বিনোদন কেন্দ্রে থাকবে ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন, বেঞ্চ ও গ্যালারি, কিড জোন এবং ফুটওভার ব্রিজসহ নানা সুবিধা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে চরের মধ্য দিয়ে নির্মিত হচ্ছে সাড়ে আট কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের সড়ক। এক সময় বিশাল চর ছিল এই অংশে। এখন একরাশ স্নিগ্ধতায়ঘেরা অপার মাধুর্য লুকিয়ে আছে কল্পলোক আবাসিকের পেছনের অংশে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। নগরীর প্রায় ৬০ লাখ নগরবাসীর জন্য পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত ছাড়া আর কোনো উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র নেই। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত নগরীর একেবারে দক্ষিণুপশ্চিম প্রান্তে হওয়াতে নগরীর উত্তরুপূর্ব প্রান্তের লোকজনের জন্য যাতায়াত অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। বাকলিয়া এলাকায় কর্ণফুলীর তীরঘেঁষে নতুন এই পর্যটন স্পট এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের বিনোদনের অভাব পূরণ হবে বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
পার্কের পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরের শিশুদের জন্য উন্মুক্ত খোলামেলা পরিবেশেরও অভাব রয়েছে। রয়েছে বিনোদন কেন্দ্রর অভাব। বিশ্লেষকরা বলেন, নগরের বিপ্লব উদ্যান বাণিজ্যিক স্থাপনায় রূপ দেওয়া হচ্ছে। জাম্বুরি পার্কেও শিশুবান্ধব তেমন কিছু নেই। ফলে সেখানে কেবল হাঁটাচলার সুযোগ রয়েছে শিশুদের। যে কটি মাঠ চট্টগ্রামে আছে, সেখানেও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নগরে যে পরিমাণ খোলা জায়গা প্রয়োজন, তার ২৫ ভাগও নেই। মাঠ ও পার্ক স্বল্পতায় অধিকাংশ অভিভাবকেরা শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন কিডস জোনের দিকে ঝুঁকছেন। এতে খরচের পাশাপাশি শিশুরা কেবল চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। তাদের মানসিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তারা মুঠোফোনসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাণিজ্যকরণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পরিকল্পনার অভাবে নগর মাঠ ও পার্কশূন্য হচ্ছে। তাঁরা বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাজীর দেউড়ি পার্কটি এখন নেই। বাণিজ্যকরণের কারণে বিপ্লব উদ্যানের মতো স্থানও হারিয়ে গেছে। ফয়’স লেক এখন আর সব আয়ের মানুষের সাধ্যে নেই।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, আমাদের চট্টগ্রামে এমন কিছু পর্যটন স্পর্ট রয়েছে, যা চোখ জুড়ানো–মুগ্ধ হওয়ার হওয়ার মতো। কিন্তু পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাকে সঠিক উদ্যোগের কারণে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। চাক্তাই–কালুরঘাট রিং রোডের বিনোদন কেন্দ্রের কাজ শেষ হলে প্রতিদিন সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন পর্যটকরা।