“আপনাদের মাঝে ছাদবাগান করেন, এমন কেউ কি আছেন”– প্রশ্নটা করেছিলেন মাটি ও মানুষ খ্যাত শাইখ সিরাজ। চট্টগ্রামে লায়নিজমের এক অনুষ্ঠানে। একটি হাত উঠল। দৃঢ়চেতা হাত। ওই হাত একজন নারীর। নাম সাহেলা আবেদীন। তিনি হাত উঠিয়ে বললেন-“আমি, আমি আছি ছাদবাগানী।”
শাইখ সিরাজের ভরাট মুখে তখন চওড়া হাসি। বললেন, “কাল সকালেই দেখতে যাবো ছাদবাগান।” সেই সকালে তিনি এসেছিলেন। একজন নারীর ছাদকৃষি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। কিছু সুন্দর আলাপচারিতায় উঠে আসে ছাদবাগানের চিত্র। যা চ্যানেল আই এবং এবং একটি জাতীয় পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন আকারে তিনি প্রকাশ করেন। নারী উদ্যোক্তা, নেত্রী, সমাজকর্মী পাশাপাশি সাহেলা আবেদীন পান নতুন তকমা– নগর কৃষির কৃষাণী। সাহেলা আবেদীন ছয়তলা ভবনের দুই হাজার ২০০ বর্গফুটের ছাদে তিন স্তরে কৃষির আয়োজন করেছেন। ইট–পাথর–ইস্পাতে গড়া যান্ত্রিক শহরের বুকে ঘটিয়েছেন ফুল আর ফসলের সম্মিলন। তবে ফুল আর ফসল উৎপাদনেই থেমে থাকেননি সাহেলা আবেদীন। ছাদকৃষিকে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট, তিনি এটিকে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন হিসেবেই দেখতে চান। নগরের সবুজায়নের আন্দোলনে শহরবাসীকে যুক্ত করতে গড়ে তুলেছেন তিলোত্তমা চট্টগ্রাম নামে সংগঠন।
সাহেলা আবেদীন বলেন, ‘শৈশবে মায়ের সঙ্গে বসে টিভিতে আপনার কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখতাম। তখনই কৃষির প্রতি মমতা তৈরি হয়। মায়ের সঙ্গে আমিও গাছ লাগাতাম। বাড়ির আঙিনায় শাক–সবজি করতাম। বিয়ের পর দেখলাম আমার শাশুড়িরও গাছের প্রতি আগ্রহ খুব। এই বাড়ি করার পর ছাদটিকে আমরা তৈরি করলাম ছাদকৃষির উপযোগী করে।’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই লিখেছিলেন, ‘বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল; নারী দিল তাহে রূপ–রসমধু–গন্ধ সুনির্মল।’ আমরা জানি, মানব সভ্যতার উষা লগ্ন থেকেই নারীরা কৃষিতে ছিলেন। তখন বীজ থেকে গাছ হওয়ার যুগান্তকারী সৃষ্টি রহস্যের সন্ধান মানূষ আবিষ্কার করেছিলো, সেই আবিষ্কারের প্রধান কারিগর ছিলেন নারী। প্রকৃতিগত ভাবেই নারী যখন বংশ বিস্তারের জন্যে শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য থাকতো সেই সময় তার শিকারের যাওয়া হয়ে উঠতো না। ঠিক সেই সময় থেকেই নারী গাছ থেকে আহরিত ফলের বীজ থেকে গজিয়ে উঠা গাছের চারা থেকে কৃষি কাজের ধারণা লাভ করে। আদিম সভ্যতার কৃষিকাজ এভাবেই শুরু হয়েছিলো নারীর হাত ধরে।
বিশ্বের কৃষিপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। তাঁরা এখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যেও সীমিত সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাঁরা কৃষিতে বিরাট অবদান রাখছেন। আমাদের বাংলাদেশের নারীরা ঐতিহাসিকভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। ফসল কাটার পর তা মাড়াই, রক্ষণাবেক্ষণসহ বেশির ভাগ কাজ তাঁরাই করে আসছেন আবহমান কাল থেকে। কিন্তু পরিবারের নেতৃত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাঁদের ভূমিকা থাকে কমই। তবে, আশার কথা এই যে, গত কয়েক যুগে পরিবারে নারীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পেশা হিসেবে কৃষি বেশ চ্যালেঞ্জিং। খামারে উৎপাদন, সংগ্রহ, প্যাকেজিং, বিক্রির প্রক্রিয়া বেশ কঠিন। সেই কঠিন কাজটি সহজভাবে নারী করতে পারে নগর কৃষিতে।
এখন পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রসার ঘটছে ছাদকৃষির। ছাদকৃষি এখন একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। একে কেন্দ্র করে বহু মানুষ যুক্ত হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে। গাছ ও তথ্য আদান–প্রদানের মাধ্যমে বাড়ছে তাদের সম্প্রীতি। সবুজ শহর গড়ার আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যয়ের বদৌলতে গড়ে উঠছে নানা সংগঠন। ব্যক্তি পর্যায়েও সফল উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই এমন অনেকেও বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের এক পাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন ছাদকৃষি।
নগর কৃষি নিয়ে আসছে আত্মিক প্রশান্তি, পরিবারের হাসি, পরিবেশের খুশি। বাড়িয়ে দিচ্ছে শহরের সবুজায়ন। নগর কৃষিতে বাড়ছে অঙিজেনের মাত্রা। কৃষিবিদরা ধারণা করছেন, আগামী এক দশক হবে বাণিজ্যিক নগর কৃষি উৎপাদন ও নগর কৃষির আধুনিক কলাকৌশল রপ্ত করার সময়। এক গবেষণায় জানা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন উন্নত দেশে ৭০% এবং বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে ১০০% ভাগ বাড়াতে হবে। যেহেতু জমির পরিমাণ কমছে এবং সকলের চাহিদা বাড়ছে তাতে উলম্ব বা ভার্টিক্যাল ফার্মিং ও বাণিজ্যিকভাবে শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। উপযুক্ততা অনুযায়ী পুষ্টি পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। তাই নগরে ফল ও সবজি চাষের জন্য ছাদ–বাগানসহ নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল নগরে টেকসইকরণের সাথে সাথে উপকরণ সহজলভ্য ও জনপ্রিয় করতে হবে।
সরকার নতুন নতুন সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে গবেষণার সাথে সাথে নতুন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করছে আধুনিক নগর কৃষি নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা, প্রকল্প নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। অনলাইন শপ, ফেসবুক পেজ তৈরী করে সকলের কাছে উপাদান পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এক একটি বাড়ির ছাদে এক একটি ফসলের মাঠে রূপান্তর করতে হবে।
নগর কৃষি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এখন অনেক সুযোগ চারপাশে। অনেক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি নিয়ে নানা কাজ হচ্ছে। তাই সহজেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে আত্ননিয়োগ করা যায়। আর এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন নারীরাই। কারণ নারীরাই সবচেয়ে বড় ‘হাউজমেকার’। ঘর সামলাতে জুড়ি নেই তাঁদের। এখন তাঁদের অধিক অংশগ্রহণে দাঁড়িয়ে যেতে পারে নগর কৃষিও। আদিকালে যাঁদের হাতে কৃষির সূচনা ঘটে, আধুনিক কালে এসে তাঁদের হাত দিয়েই আসতে পাওে নগর কৃষির নতুন মাত্রা।
লেখক: উপ–পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।