বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের বহুমাত্রিক পাঠে ‘নকশবন্দী’র সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও এর উৎসের গূঢ়তত্ত্বে আমরা দেখি, ‘নকশবন্দী‘ হল ইসলামের একটি সুফী আদেশ যা আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা, সমপ্রদায়ের নিযুক্তি এবং ঈশ্বরের নীরব স্মরণ অনুশীলনের উপর জোর দেওয়ার প্রস্তুতি। এটি ইসলামের মধ্যে একটি বিশিষ্ট সুফী আদেশ বা আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা, সমপ্রদায়ের ব্যস্ততা ও ঈশ্বরের নীরব স্মরণ অনুশীলনের উপর জোর দেবার জন্য পরিচিতি। এটি হযরত শায়ক বাহাউদ্দিন নকশবন্দী বুখারীর(১৩১৮–১৩৭৯) শিক্ষা থেকে নেয়া। তিনিই সুফী নকশবন্দী আদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নকশবন্দীয়া ত্বরীকার বিবাদ সহজ করার জন্য ‘তাসাউফ’ চর্চাকে কলব থেকে শুরু করেন। অর্থাৎ একজন সালিক (সাধন পথের পথিক বা মুর্শিদ বা সুফী সাধক) প্রথমে নফস (প্রবৃত্তি, কামনা, বাসনা) দমন করে কলবী (হৃদয়, মন) জিকির করে তাকমিল (প্রকৃত খোদাভীতি) হাসিল করবে। নফস দমন করা একটি কঠিন কাজ। যিনি দ্বীনের মাঝে নানাবিধ বেদাত নির্মূল ও দ্বীন সংস্কার করবে তাকে নকশবন্দীয় মজাদ্দিদিয়া বলা হয়। নফস, ইলমে তাসাউফ, জিকির, তকমিল হাসিল এর অন্তর্ভূক্ত। যেমন, ১. শৃংখলাবদ্ধ হওয়া অর্থাৎ জীবনকে সুশৃঙ্খলিত করা। ২. শাহাদাত বা ঈশ্বরের একত্ব ঘোষণা ও মুহাম্মদকে নবী হিসেবে গ্রহণ করা। ৩. অনুতপ্ত হওয়া, ধার্মিকতায় ফিরে আসা। ৪. ঈশ্বরের উপস্থিতিতে মনোনিবেশ করা অর্থাৎ ঈশ্বরকে নীরবে স্মরণকালে ঈশ্বর স্বয়ং সম্মুখে উপস্থিত ভেবে নেয়া। সুতরাং নকশবন্দী হল ইসলামের অন্তর্গত একটি সুফী ত্বরীকা। সুফী ত্বরীকা গুলির মধ্যে শুধু একটি হযরত আবু বকরের মাধ্যমে মুহাম্মদের সাথে সম্পর্কিত করে। কিছু নকশবন্দীধারা অবশ্য নিজেদেরকে চতুর্থ খলিফা আলীর মাধ্যমে মুহাম্মদের সাথে সম্পর্কিত করে। নকশবন্দীয়া ত্বরীকার আত্মশুদ্ধির ত্বরিকাগুলির অনেক টুকুই সুন্নাহ সম্মত। তাদের সুচনা হয়েছে সুন্নাহর অনুসরণ করে, শিরক, বিদাত নাকচ করে আত্মশুদ্ধির হাসিল করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে। নকশবন্দীর সুফী ধারা ছিল ভারতে সবচাইতে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে ব্যাপক সুফীধারা। ভারতের চারটি প্রধান রাজবংশ (তুঘলক, লোদী, বাহমানী ও মুঘল) এই বিশেষ আদেশের অনুসারী ছিল। ‘ঐশী জ্যোতি’ পুস্তক সম্পর্কে মতামত প্রদানকালে গবেষেক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিয়ান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; বলেছেন, ‘এই পৃথিবীতে সুফী হওয়া বড়ই কঠিন। অনেক ত্যাগ ও সংযমের প্রয়োজন। যদিও সাহাবাদের সময় থেকে সুফীবাদের চর্চা শুরু। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহঃ) মতে আরাম আয়েশ ত্যাগ করা এবং আল্লাহ্কে পাবার উদ্দেশ্যে দুঃখ কষ্টকে বরণ করাই প্রকৃত সুফীবাদ। আবার কারো কারো মতে সুফীবাদ হচ্ছে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের পথ ও চলার নিয়ম পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা’। হযরত শাহ সূফী মৌলানা এম কে ঈছা আহমেদ নকশবন্দী (রাহঃ) তেমনি একজন সুফী সাধক। তার রচিত ঐশীপ্রেম, ঐশীজ্যোতি, জাগরণী, তোহফা, উপনয়ন, গীতমালা ও গুরুধন নামের গ্রন্থে প্রায় দুই হাজার দুই শতেরও অধিক সংগীত ও ‘স্মৃতির পাতা’ নামের গ্রন্থে আত্মবিলোপনের পথ ও পদ্ধতির বিভিন্ন দিক নির্দেশনা আছে। আমরা এ পর্যায়ে তাঁর গ্রন্থ ‘ঐশী জ্যোতি’ সম্পর্কে ঈছার ওফাত দিবসের আলোকে সাম্যক আলোকপাত করব। ঈশ প্রবণতা থেকে ঈশ্বরত্ব তথা আল্লাহিয়াত লাভ করার মধ্যেই মানবজন্মের সার্থকতা নিহিত। যারা ইশকে এলাহির আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়েও সত্যভাষণে অটল ঈশপ্রাণ ‘ফকির’ তারাই মানব বিশ্বের মহাসম্পদ এবং দেশ কাল ছাপিয়ে সর্বমানবের জন্য প্রকৃত সত্য– সুপথদাতা। হযরত শাহসুফী এম কে ঈছা আহমেদ নকশবন্দী (রাহঃ) তেমনই একজন পূর্ণমানব তথা ইনসানে কামেল। কোরানে বর্ণিত ‘আলিয়েম মোর্শেদা’র সাথে অবিচ্ছেদ্য প্রেমাকর্ষণে বিকাশমান সাধকচিত্তে ফুল্লধারার মত যে অনুপম অমিয়বাণীর স্বতোৎসারণ ঘটে সেটাই অহি বা এলহাম তথা ঐশীবাণী। ‘আলে মোহাম্মদ’ রুপী একজন পরিসিদ্ধ মহাপুরুষের প্রতি ঈশপ্রাণতা মানে নিবিষ্ট চিত্ত প্রেম, ভক্তিসঞ্জাত ঐশীবোধই এমন মহাভাববিভূথিময় ঐশীবাণীর উৎস স্বরূপ।
দেহ নামক হেরাগুহায় সাধনার এক পর্যায়ে সাধকের উপর কোরান নাজেল হওয়া সর্বকালীন ঐশীবাণী প্রকাশেরই নামান্তর। সুর ছাড়া নূর নেই। সুরের সাধনাই আল্লাহর নূরের সাধনারাজ্যে প্রবেশাধিকার লাভের পারথম সোপান। মহাজাগতিক সুরমণ্ডলে যে সুগভীর সুরধ্বনি ধারায় সাধু সাঁইজী অবিরাম বিচরণ করেন তার বিকাশক্রমকে তিনি এমন সাবলীল ঐশ্বর্যে সুললিত ‘ঐশীজ্যোতি’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন যাতে কাব্যিক নৈপুণ্য জটিলতার চেয়ে মানবীয় মহাত্মাময় সারল্যের দাবীটাই অনেক বড় হয়ে উঠে। তিনি আপন সহজতায় কোরানের সর্বকালীন ও সার্বজনীন অখণ্ড দর্শনকে মহতী ঔদার্যে প্রকাশ করেন। সত্যপ্রীতির কঠিন দায়বোধ থেকেই এই সুফী তার আত্মানুভবকে গীতিকাব্যিক ঢংয়ে অভিব্যক্ত করে আমাদের অসুরিক দম্ভ বিনাশের চিরকালীন সাহিত্যিক নিদর্শন রেখেছেন। তাই সাধক ছাড়া আর কেহ তত্ত্বসাহিত্যের মর্মে প্রবেশ করতে পারে না। ‘ঐশী জ্যোতি’ একটি আধ্যাত্মিক, দেহতাত্ত্বিক, মরমী ধর্মতাত্বিক, সুফী ভাবময়তায় কাব্যের, সংগীতের, শব্দের, ছন্দের গতিময়তা পরিপূর্ণ ধ্যানী গ্রন্থ। শব্দ ব্যবহারে ও সামগ্রিক চিন্তা চেতনায় সম্পূর্ণ ইসলামী ধারার আঙ্গিকে আল্লাহ্, রসুল, মালীক, তৌহিদ, মুর্শিদ, ঈশ্বর প্রেম, আল্লাহর ধ্যান, নামায ইত্যাদির প্রাধান্য । তিনি লেখেন, ‘ধ্যানের ছবি নাম আঁক, চঞ্চল মন রবে নাকো স্থির আসনে অটল থাক, রাখ দৃষ্টি বিনয় যোগে। ছাড় ঈছা মোহকাম, শেষ ঠিকানা লা মোকাম কর্মকর সোবেহ সাম, নিশ্চিত মুক্তি কর্ম যোগে’। পৃ :৪৭ বইয়ের শেষ পিঠে তার অমিয় বাণীতে আছে, ‘জগতের সবকিছু স্বভাবিক পরিবর্তন হয় কিন্তু মানবের সাধনা ছাড়া কোন স্বভাবের পরিবর্তন হয় না। ১. আত্মিক পবিত্রতা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বাড়ায়। ২. স্রষ্টার গুণে গুণাণ্বিত ব্যক্তিরাই নীরব ও উদার। ৩. কামেল পীর দর্শনলাভে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, কারণ তারা হলেন আল্লাতায়ালার নূরের ছায়া বিশেষ। ৪. সৎ সংগীত অন্তরকে স্বচ্ছ ও নির্মল করে। ৫. আত্মাকে জাগাতে হলে পরমাত্মার সাথে সংযোগ স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই। ৬. একজন ভাত খেলে যেমন অন্যের পেটে যায় না তেমনি আল্লাহর সাধনা নিজেকে করতে হবে, অপরে করলে হবে না। ৭. ধ্যান ধারণা বা মোরাকেবা মোশাহেদা ছাড়া আধ্যাত্ম রাজ্যের সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর বিষয়ক তত্ত্বের প্রদেশে প্রবেশ করা যায় না। ৮. জাগতিক আকর্ষণ পরিহার ও মাওলার সাথে বন্ধুত্ব করার প্রচেষ্টার নাম তাসাউফ । ৯. যোগ্য বা জ্ঞানী ব্যক্তির বংশ পরিচয়ের দরকার নেই। ১০. মানব জীবন জ্বলন্ত প্রদীপের মত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। এই মহাপুরুষ চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার ছিপাতলী গ্রামে ১৯৪৬ ইংরেজী সনের ৩ জুন দেহ লাভ করেন। একপর্যায়ে তিনি মৌলুবী আবুল খায়ের নকশবন্দী (রহঃ) এর সাক্ষাৎ লাভ করেন ও বায়াত গ্রহণ করেন। মৌলুবী আবুল খায়ের নকশবন্দী সাহেবের মৃত্যুর পর দরবারের ভক্তগণের অনুরোধে খায়ের মঞ্জিল দরবার শরীফের হুজুর কেবলার উত্তরসূরি হিসেবে ঈছা আহমেদ দরবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এহেন ক্ষণজন্মা মহাসাধক অগণিত মুরিদ ভক্ত আশেকদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে ২০০২ ইংরেজী সন, বাংলা ২ কাকি ২৪০৯ সালে দেহ ত্যাগ করেন। তার লেখা যেমন, ‘মানুষ চিনা হল দায় শ্বাসের সাথে পরম মানুষ নিত্য আসে যায়’। পৃ: ৬৭ আবার ‘ভাব হরদম মুর্শিদ চরণ, নক্স আল্লাহ্ লই স্মরণ শয়নে জাগনে ধ্যানে মিলিবে তার দরশন মুর্শিদ চরণ হলে সার মিশে হবে একাকার ঐ কদমে সিদ্ধি তার মিলে কাবা বৃন্দাবন’। পৃ: ৬৩ অন্যভাবে, ‘ভক্তহৃদয় কাবা গয়াকাশী ঐ আকাশে সদা বাজে প্রেমানন্দ কালাশশী’। পৃ: ৬৩। বা ‘জীব জড় নর নারী, শুকপক্ষী যত হেরি দেখা কেবল রকমারি, আসল কিন্তু ঐ। ভাবি চিন্তি ঈছা বলে, একে বহু মিশে গেলে মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ পেলে, সত্য কথা কই’। পৃ:২ ‘ঐশী জ্যোতি‘ গ্রন্থের সর্বাঙ্গে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের অনুভূতি, উপলব্ধি ও ভাবের বিভোরতায়, শব্দের গাঁথুনিতে, কাব্যের ছন্দে, হৃদয়ে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। ‘ঐশী জ্যোতি’ গ্রন্থের জ্যোতিতে মানবজনম, বিশ্বের সকল প্রাণ হয়ে উঠুক গীতবাদ্যনৃত্যযোগে আকুল।
লেখক: সংগীতশিল্পী, গীতিকবি, প্রাবন্ধিক।