প্রসাধনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সেই আদি যুগ থেকেই। আধুনিক যুগে প্রসাধন খাতে ব্যয় হাজার হাজার কোটি টাকার অঙ্ককেও ছাড়াতে বসেছে। কালের বিবর্তনে নাগরিকদের কেনার সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও বাড়ছে প্রসাধনের ব্যবহার। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রসাধন প্রতারণা! ‘ত্বক ফর্সাকারী’ বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীর চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন বয়সী নারী–পুরুষ। ‘সৌন্দর্য বর্ধনকারী’ এসব প্রসাধন সামগ্রী কিনে ক্রেতা সাধারণ প্রতিদিনই প্রতারিত হচ্ছেন। ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারে বিভিন্ন রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। চর্মরোগ, কিডনি রোগ ও ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি সত্ত্বেও থেমে নেই এ অবৈধ ব্যবসা। এদিকে ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় ওই সব প্রসাধনীর দামও বেড়েছে। প্রকারভেদে এ সব পণ্যের দাম হয়েছে কয়েকগুণ। মূলত এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নকল প্রসাধনীতে ভরে উঠেছে বাজার। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে নগরের ডবলমুরিং থানার ধনিয়ালাপাড়া ছোট মসজিদ বাইলেইন রোডের একটি বাসায় নামীদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনী তৈরি করার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের উপ–পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, ভেজাল এসব প্রসাধনী ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে সামনে রেখে প্যাকেজের মাধ্যমে ফুটপাতসহ ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা বিক্রি করেন। কমদামে পেয়ে নামীদামি ব্র্যান্ডের এসব পণ্য কিনে ঠকছেন ক্রেতারা।
ক্ষতিকর রাসায়নিকে তৈরি পণ্য ব্যবহারে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা করেছেন বিশিষ্ট চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ক্ষতিকারক এসব প্রসাধনী ব্যবহারে সাধারণ চর্ম রোগ থেকে শুরু করে মরণঘাতী ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, যেমন ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমে তারা স্টেরয়েড ব্যবহার করে। যেটি দীর্ঘদিন ব্যবহারে চামড়া নরম ও পাতলা হয়ে যায়। আমাদের শরীরে চামড়া ভেতরের অংশকে বিভিন্ন রাসায়সিক পদার্থের হাত থেকে রক্ষা করে। এখন চামড়া নিজেই যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তা শরীরের ভেতরকার অংশগুলোকে কী করে রক্ষা করবে? দোকানে দোকানে অভিযান নয়, তার পরামর্শ যেখানে উৎপাদন হয় সেই কারখানায় অভিযান চালিয়ে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
নারী সৌন্দর্য বহুলাংশে বৃদ্ধি করে সুন্দর, ঘন এবং লম্বা চুল। আর এ কারণেই প্রাচীনকাল থেকে চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের শ্যাম্পুর ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমান বাজার ভেজাল শ্যাম্পুতে ভরে গেছে। আর এতে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ ক্রেতারা। একইভাবে পেট্রোলিয়াম জেলির সাথে তরল রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে বানানো হচ্ছে ভেজাল ভেসলিন। শুধু ভেসলিন নয়, এইভাবে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন বিদেশি কসমেটিকসসহ রং ফর্সাকারী ক্রিম। ক্ষতিকর রাসায়নিকের সঙ্গে রং মিশিয়ে বানানো হচ্ছে নানা নামের মেহেদি। আর পানির সঙ্গে স্পিরিট ও সুগন্ধি মিশিয়ে, নামীদামি ব্র্যান্ডের সেন্টের খালি বোতলে ভরে বিক্রি হচ্ছে পারফিউম নামে।
স্বাস্থ্য বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে যে পরিমাণ কসমেটিকস অর্থাৎ ক্রিম, শ্যাপু , সাবান, লোশন, আফটার–শেভ লোশন, পারফিউমসহ যেসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে দেশীয় কোম্পানি থেকে। আর ১৫ শতাংশ আমদানি করা হয় দেশের বাইরে থেকে। বাকি ৭০ শতাংশ কসমেটিকস নকল ও ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে। পণ্যের গুণগতমান সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই ভোক্তার। কারণ, পণ্যের গায়ে ব্যবহৃত উপকরণ সম্পর্কে ভোক্তা জ্ঞানশূন্য। তাছাড়া পণ্যের গায়ে ও লেভেলে মেড ইন আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, দুবাই, ইংল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাম লেখা থাকে। অথচ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নিম্নমানের পণ্যই ওইসব বোতলে ভরে বাজারজাত করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্বমানের ব্র্যান্ড গার্নিয়ার, লরেল, রেভলন, হেড এ্যান্ড শোল্ডার, লাঙ লোশন, মাস্ক লোশন, এ্যাকুয়া মেরিন লোশন, পেনটিন, নিভিয়া লোশন, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান; সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, পয়জন, রয়েল, হ্যাভক ও কোবরা; অলিভ অয়েল, কিওকারপিন, আমলা, আফটার সেভ লোশন, জনসন, ভ্যাসেলিন হেয়ার টনিক, জিলেট ফোম, প্যানটিন প্রোভি ও হারবাল এ্যাসেনশিয়াল লোশনের নামে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর ইপিজেড, আগ্রাবাদ, স্টেশন রোড, বহদ্দারহাট, রেয়াজুদ্দিন বাজার, দুই নম্বর গেইটসহ বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতের পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেশনারি দোকানে ও মার্কেটে হরদম বিক্রি হচ্ছে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী সামগ্রী। উক্ত স্থানগুলোতে দেখা যায় রাস্তার দুধার এবং দুই–তিন তলা মার্কেটে সারি সারি কসমেটিকসের দোকান। মূলত এ দোকানগুলো থেকে পাইকারি হারে বিক্রি হয় এসব পণ্য। এখানে দেশি, বিদেশি পণ্য যেমন পাওয়া যায় তেমনি পাওয়া যায় তাদের ভাষায় দুই নম্বর কসমেটিকসও। তবে দু’নম্বরের মধ্যে দেশি–বিদেশি নামকরা ব্র্যান্ডের পণ্যও রয়েছে। এসব দোকানে মিলছে নিম্নমানের ফেস পাউডার, মেকআপ বঙ, আইলাইনার, আইব্রু, লিপ লাইনার, লিপস্টিক, নেইল পলিশ, মেহেদী, হেয়ার ওয়েলসহ রকমারি পণ্য। এসব দোকান থেকেই কেনা নকল প্রসাধনী হাত ঘুরে মফস্বল ও গ্রামের বিপণী বিতানে ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত মফস্বল এলাকাকে টার্গেট করেই এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এসব পণ্য কিনে আনে। চকচকে মোড়কে ভেজাল পণ্য দেখে ক্রেতারা সহজেই ঠাহর করতে পারছেন না এটি আসল না কী নকল।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন আজাদীকে বলেন, খাদ্যদ্রব্য বা অন্য যেকোনো পণ্যের চেয়ে প্রসাধন সামগ্রীতে ভেজাল বেশি হচ্ছে। এটা বড় উদ্বেগের কারণ। চট্টগ্রাম শুধু নয়, ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জসহ প্রায় সব অঞ্চলেই চলছে ভেজাল প্রসাধনী উৎপাদন ও বিপণন। উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করতে হলে নজরদারী আরো বাড়াতে হবে। মান নিয়ন্ত্রণ যেন যথাযথভাবে হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।