অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ধর্ষক ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ধর্ষণ করে আসছে আমাদেরই কোনো মা-বোন-মেয়েকে বারবার। আর মেয়রাও নিজের/পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে, সমাজের ভয়ে মুখ না খুলে ধর্ষিতা হচ্ছে দিনের পর দিন। এতে একদিকে যেমন প্রশ্রয় পাচ্ছে ধর্ষক, তেমনি পেয়ে পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে হায়েনার দল। বাড়ছে ওদের সাহস। একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হচ্ছে এ রোগ। যেসব ঘটনা সামনে আসছে তা থেকে এই চিত্র পরিষ্কার। শুধু যেসব ঘটনা সামনে আসছে সেগুলো আমরা জানতে পারছি। কিন্তু কত শত ঘটনা আরও এমন আছে কে জানে, যা মেয়েরা নীরবে মুখবুজে সহ্য করে চলেছে ভয়ে, লোকলজ্জায়, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে!
বিচারহীনতা অথবা দীর্ঘায়িত বিচারব্যবস্থা, নামকাওয়াস্তা শাস্তির কারণেই কি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ধর্ষণ? বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করার কোনই কি উপায় নেই? আমরা দেখতে পাই ধর্ষণ মামলার আসামী জামিনে বের হয়ে আসার পর তাকে ফুলের মালা দিয়ে সম্বর্ধনা জানাচ্ছে তার দলের লোকজন, জামিনে এসে আবারও অঘটন ঘটাচ্ছে আসামী।এই ঘৃণ্য অপরাধী কিভাবে জামিন পায়? আইনের এসমস্ত ফাঁক যতদিন থাকবে, ততদিন অপরাধীর সংখ্যাও বাড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই ।
ধর্ষণ মামলার আসামীকে কোনভাবেই জামিন না দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব (যদি সম্ভব হয় সাত দিনের ভেতর) শাস্তি নিশ্চিত করে তা বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েদের অত্যাচারের চিত্র যেমন সোস্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়, শাস্তি কার্যকরের ভিডিও’ ও তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করা প্রয়োজন।এক্ষেত্রে আমাদের মানবিক হলে চলবে না। নরপশুদের সাথে এটুকু পাশবিক আচরণ আমরা করতেই পারি সমগোত্রীয় অন্যদের ভিত করতে।
ঘটনাগুলো শোনার পর রাগ-দুঃখ-ভয় -লজ্জা-অসম্মান সবগুলোর সংমিশ্রণে মনেএক চরম অশান্তি দানা বেঁধে বুকের মাঝখানে আটকে থাকে। আমরা আমাদের মেয়েদের নিয়ে যেমন ভীত, ছেলেদের নিয়েও ঠিক তেমনি সংকিত। চিন্তা করলে হাজারও ‘কেন?’ এসে ভিড় করে মনে। এই নরপশুরাও কি আমাদের মত কোন মায়ের জঠর থেকে জন্ম নেয়া সন্তান? কেমন ছিল এদের ছেলেবেলা? এদের প্রতিপালনে কিসের ঘাটতি ছিল? কি কারণে মেয়েদের প্রতি এদের এত আক্রোশ? কে এরা যাদের কাছে মা, বোন কোন সম্পর্কই কোন মানে রাখে না! কেনো এদের এই নোংরা মানসিকতা? কারা দায়ী তাদের এ অবস্থার জন্য? কেনো মেয়েরা আজও ঘরে ঘরে নিগৃহীত? কি এদের দোষ?
কেন? কেন? কেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও অজস্র অসম্মানজনক কমেন্ট দেখে চোখে একটু আলোর রেখাও দেখতে পাই না -এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যদি এখনও না ভাবি তবে আর ভাববো কখন!
অপরাধীদের ফাঁসি বা ক্রসফায়ারে দেয়া যেমন সময়ের দাবী, সেই সাথে উপরোল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করাও খুব জরুরি। এই মানসিক বিকৃতির কারণগুলো খুঁজে বের করে যতক্ষণ পর্যন্ত না যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যাবে, ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ যেভাবে বাড়ছে তা মহামারীর আকার ধারণ করতে খুব একটা বেশি সময় লাগবে না।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থায় ইন্টারনেট একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। আমাদের সন্তানেরা খেলতে জানে না, সংস্কৃতি চর্চা বোঝে না, বই পড়ে আনন্দ নিতে জানে না, ক্রিয়েটিভ আড্ডা সম্পর্কে অজ্ঞ! শহরগুলোর স্কুলে খেলার মাঠ নেই, বাড়ির সামনে উঠোন নেই, আশেপাশে পুকুর নেই, বাড়িতে দাদু-দিদা, কাকা-জ্যাঠা নেই, একই বাড়িতে থাকলেও দাদু-দিদার সাথে সময় কাটাবার সময় নেই, মামার গল্প শোনবার সময় নেই। শৈশব হারিয়েছে সারল্য, কৈশর হারিয়েছে দুরন্তপনা, যৌবনের উদ্দামতার জায়গায় গেড়ে বসেছে বিষণ্নতা! নেই বলতে আমরা যা পেয়েছি তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন (ব্যতিক্রম থাকলেও তা সংখ্যায় নগণ্য)। হাজারও না থাকার মাঝে যা আছে, তা হলো হাতের মুঠোয় পুরো পৃথিবী। যে যার পছন্দনীয় বিষয় নিয়ে ডুবে আছে ‘মুঠো’র পৃথিবীতে। আমাদের সবার দৃষ্টি আটকে গেছে ওই এক জায়গায়। শুরুটা শিশু অবস্থাতেই। বাচ্চাকে খাওয়ানো থেকে, কান্না থামানো, গান শোনানো, নাচ দেখানো, কার্টুন দেখানো, অ আ শেখানো সব ওই যন্ত্রের মাধ্যমে। আমাদের দৃষ্টি ছোট গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকতে থাকতে মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। আকাশের দিকে তাকালে তবেই তো উদার হতে শিখবো, সবুজের দিকে চাইলে তবেই তো সতেজতা আসবে জীবনে, সমুদ্রের ঢেউ দেখলেই শিখবো উত্তাল হতে, শান্ত নদীর দিকে তাকালে তবেই তো বুঝবো স্থিরতার প্রশান্তি। গাছের ছায়ায় বসে পাখির ডাক শুনলে মায়ায় জড়াবো আমরা একে অপরের সাথে- এগুলো করতে হলে প্রয়োজন প্রসারিত দৃষ্টি, কিন্তু এর সুযোগ কোথায়! মাথা নুইয়ে থাকতে থাকতে আমরা ভুলে যাচ্ছি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে!
বের হলে রাস্তায়, বাসে, রিকশায়, ট্যাক্সিতে, লিফ্েট সবার মাথা নীচের দিকে।একটা চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ে চার কিংবা ছয় অথবা তারও বেশি বন্ধু হয়তো বসে আছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। সবার চোখ যার যার মুঠোফোনে বন্দী। চোখ যদি এদিক ওদিক না ঘোরে, তাহলে বাড়ি থেকে বের হয়ে লাভ কি? দীর্ঘদিন একসাথে বসবাস করার পরও আমাদের পাশের বাড়ির অথবা ফ্ল্যাটের কাউকে চেনে না আমাদের সন্তান, কারো কোন বিপদ কেয়ার করে না, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়বাড়ি যেতে চায় না, কারো কোন বিপদ জানলেও এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা হারিয়েছে আমাদের সন্তানেরা। শুধু সন্তানেরা নয়, দিনদিন চূড়ান্ত স্বার্থপর হয়ে উঠছি আমরা সবাই। আশেপাশে কি হচ্ছে, কি ঘটছে তা চাক্ষুষ করার কোন আগ্রহ নেই। সবই জানছি তবে তা ওই ছোট যন্ত্রটার মাধ্যমে।
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আমাদের মত দেশে কল্যাণের চাইতে অকল্যাণ ডেকে আনছে বেশি। অশিক্ষিত লোকজন পড়তে না জানলেও ভিডিও দেখে, কানে শুনে হাতে কলমে কু’কাজগুলো শিখছে। অশিক্ষা, আর বিচারহীনতার কারণে পরবর্তী অবস্থা চিন্তা না করে নানারকম অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে অপরাধী। আমরা পুরোপুরি ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়েছি এই ছোট যন্ত্রটার ওপর। এই যন্ত্র আমাদের চিন্তা চেতনার বিনাশ করেছে। কর্মক্ষমতা কমিয়েছে। মানুষ কাজে অনাগ্রহ দেখা দিচ্ছে। কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারছি না কেউ ফলে কাজও ভালো হচ্ছে না। ইন্টারনেট একদিকে যেমন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছে, তুলে ধরছে চোখের সামনে সকল ‘সু’, তেমনি ‘কু’ ফন্দি ফিকির হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে নীচু মানসিকতার মানুষগুলোকে ‘কু’ প্রভাবিত করছে খুব বেশী, আর তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পারছি! যাইহোক ধর্ষণের শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ শুনে আমরা একটু আশ্বস্ত হয়েছি। তবে বিচার ব্যবস্থা যদি দীর্ঘায়িত হয় এর সুফল কিন্তু পাওয়া যাবে না। বিচার, রায় অবশেষে রায় কার্যকর করতে হবে খুব দ্রুত। আর আমরা সবাই বিচার কার্যকর করার ছবি খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের আনাচে কানাচে সবজায়গায় পৌঁছে দেবো এই খবর। এক্ষেত্রে খবরটা ভাইরাল হলে সমাজ উপকৃত হবে। লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার