ধর্ষণ রোধে প্রয়োজন আমূল মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক পরিবর্তন

রিতু পারভি | শনিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

ধর্ষণ এমন একটি শব্দ যা উচ্চারণ বা শ্রবণের সাথে সাথে হৃদপিণ্ডে হয় তীব্র ক্ষরণ, অসাড় হয়ে পড়ে বোধ। অমানবিক, নিষ্ঠুর এক পেষণের নাম ধর্ষণ। ধর্ষণে নারী বা পুরুষ যে কেউ নির্যাতিত হতে পারে কিন্তু প্রকট লিঙ্গ বৈষম্যের এই সমাজে ধর্ষণের প্রধান শিকার মূলত নারী ও শিশু। একের পর এক ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনায় কেঁপে উঠেছে সমাজ। প্রশ্ন উঠেছে আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে কেন ধর্ষণের ঘটনা।
নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের কারণ অনুসন্ধানে অনেক গবেষণা হয়েছে। ধর্ষণ পুরোপুরি একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এর মূলে কোন একক ফ্যাক্টর কাজ করে না। এর বহুমাত্রিক কারণ সমূহ তো যুগ যুগ ধরে সমাজপতিরা সমাজে লালন করে আসছেই তার সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন মনস্তাত্ত্বিক ও বিতর্কিত অনুষঙ্গ। ধর্ষণের কারণ অনুসন্ধানে দ্বিধাবিভক্ত আজ সমাজ।
ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে ধর্ষণ বেড়েছে বলে মনে করেন দেশের বিরাট এক অংশ। তাদের মতে উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি, নারীদের খোলামেলা পোশাক পরিধান, নিজেকে পর্দার আড়াল না করার কারণেই ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ঘটনা বা নারীদের পর্দা করার ব্যাপারটা বিগত এক বা দুই দশকে যেভাবে বেড়েছে তা আগে কখনো ছিল না। আবার ধর্ষণের ঘটনাও বিগত এক বা দুই দশকে যে হারে বেড়েছে তা আগে ছিল না। ধর্ষণের শিকার হয়েছ এমন বহু নারী পর্দা করতেন। ছোট ছোট শিশুরাও এর থেকে রেহাই পায়নি। এমনকি মাদ্রাসার ছেলে শিশুরাও তাদের শিক্ষকদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে এবং তা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। সুতরাং নারীর পর্দাহীন চলাচল বা ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে পরিত্যক্ত করা যায় সহজেই।
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে অবদমন ধর্ষণের অন্যতম কারণ। যৌন শিক্ষার অভাব, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অনুপস্থিতি, অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক অস্থিরতা, আইন প্রয়োগে গাফিলতি, রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চর্চা, সর্বোপরি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে ধর্ষণের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়।
আমাদের সমাজ এবং সংস্কৃতিতে যৌন শিক্ষাকে সু-নজরে দেখা হয় না। একটা গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপারকে রাখা হয় সম্পুর্ণ আড়াল করে। শিশু কিশোরদের মনে তৈরি হয় কৌতূহল, তারা হয় ভ্রান্ত, আশ্রয় নেয় ভুল পথের। অথচ সঠিক সময়ে সঠিক শিক্ষা এবং সাহায্যের মাধ্যমে যৌন বিষয়টা স্বাভাবিক এবং সুন্দর হতে পারে। সুস্থ্য সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলার মাধ্যমে সমাজ তৈরি করতে পারে সুস্থ মানুষ যার মধ্যে কখনই তৈরি হবে না ধর্ষণের মানসিকতা।
অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশ এবং অস্থির সমাজও ধর্ষণের জন্য দায়বদ্ধ। ধর্ষণ রোধ করতে হলে পারিবারিক বন্ধন, শিক্ষা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিলোপ ও নারী- পুরুষের সমতার চর্চাটা মূলত পরিবার থেকেই শুরু হওয়া অত্যন্ত জরুরী। ছেলে সন্তান এবং মেয়ে সন্তানের মধ্যে পার্থক্য না করে তাদের মধ্যে সুস্থ্য মানুষ তৈরির মূল কাজটাই শুরু হয় পরিবার থেকে। নারীদের সম্মান করার শিক্ষাটা শুরুই হয় পরিবার থেকে। এরপরেই আসে সমাজ ও রাষ্ট্রের আবশ্যিক ভূমিকা।
সঠিক আইন এবং আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই কেবল একটা সুস্থ্য সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। বর্তমানে সমাজের মধ্যে যে চরম অস্থিরতা এবং উপর্যুপরি ধর্ষণের ঘটনা তার মূলেই রয়েছে রাষ্ট্রের দায়হীনতা, বিচারহীনতা। আইনের সঠিক এবং কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব। সুস্থ সমাজ গড়তে রাষ্ট্রের ভুমিকাই আসল।
প্রান্তিক বা অপেক্ষাকৃত দূর্বলের প্রতি ধর্ষণের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ্য করা হয়। যে কারণে পাহাড়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার নারীরা, অন্যান্য জায়গায় সংখ্যালঘু নারীরা এবং দুর্বল কন্যা শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়। কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আপাতত এই নির্যাতন বন্ধ করা গেলেও এর চিরতরে বিলোপের জন্য প্রয়োজন আমূল সামাজিক পরিবর্তন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো ধর্ষণের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বারবার। যার সাথে অবধারিত ভাবে যে অনুষঙ্গ গুলো জড়িত তা হল ধর্ম ও রাজনীতি।
ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ইতিহাস বহু যুগের। বেশীর ভাগ ধর্মে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে পুরুষকে এবং নারীকে করা হয়েছে অন্তরীণ এবং ক্ষমতাহীন। ক্ষমতা চর্চার এই রীতি যেমন হাজার বছরের পুরনো, নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের সংস্কৃতিও হাজার বছরের পুরনো। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে ধর্ষণের কান্নার ইতিহাস নতুন নয়। এই অসুস্থ সংস্কৃতি ভাঙার চেষ্টার ইতিহাসও তেমন নেই। ধর্ষণ রোধে কাজ শুরু করতে হবে তাই গোড়ায় গিয়ে। মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ছাড়া চিরতরে ধর্ষণ রোধ কখনই সম্ভব না। সমাজ, সংস্কৃতির এমন গভীরে এর মূল প্রবেশ করেছে যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এর ব্যপ্তি আর থেমে নাই।
সামপ্রতিক ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের জের ধরে প্রধানমন্ত্রী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন মন্ত্রী পরিষদে উত্থাপন করেছেন। এটি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কিন্তু এক্ষেত্রে রয়েছে বিতর্ক। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এর প্রয়োগের ব্যাপার রয়েছে। আবার ধর্ষকের মনস্তত্ত্বে এর বিরূপ কোন প্রতিক্রিয়া পড়ে কি না সে ব্যাপারে অনেকেই দ্বিধা বিভক্ত। এক্ষেত্রে ধর্ষণের পর হত্যার প্রবণতা বেড়ে যায় কি না সে ব্যাপারে রয়েছে প্রশ্ন। সামপ্রতিক সময়ে যে হারে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে তাতে আইনের কঠোরতা অত্যন্ত জরুরী।
ধর্ষণের মূলোৎপাটনে মানুষের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন, সুস্থ সামাজিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা, আইনের দ্রুত এবং সঠিক প্রয়োগ সহ সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন জরুরী। শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে দেশের বিরাট একটি অংশ ধর্ষণ রোধের যে পথ নির্দেশ করছেন তা দিয়ে যে ধর্ষণ রোধ সম্ভব নয় সেটা তাদের বুঝতে হবে। তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে একটা সুস্থ সমাজ তৈরিতে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগাউছিয়া কমিটিকে লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগংয়ের সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান
পরবর্তী নিবন্ধমা যেন এক পরশপাথর