কাকতালীয়ভাবে বিদ্যালয়ে পাঠ্য ‘ধর্ম শিক্ষা’ বইয়ের বাইরে হাই স্কুল ও এইচএসসি’র ছাত্রত্ব অবস্থায় নানাবিধ ধর্ম পুস্তক আমার হাতে এসে পড়ে। তখন বিবেকানন্দ রচনাবলির, বিশেষত কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ ইত্যাদি পাঠ করে ধর্মের উচ্চভাব প্রথম অনুধাবন করি। সে থেকে আজতক যখন যে কোন ধর্ম সম্পর্কিত কোনো গভীর লেখা চোখে পড়ে বা কানে লাগে তা গ্রহণ করার জন্য চিত্ত উদগ্রীব হয়ে ওঠে। সবিনয়ে জানাই, এতে আমি এ বিষয়ের কোন বোদ্ধা হয়ে যাইনি, কিন্তু ধর্ম নিয়ে মানবগ্রহে ঝগড়া বিবাদ পৈচাশিক কর্মকাণ্ড ও রক্তপাতে বেদনাবিদ্ধ থাকি বলে এসব কথকতা।
মূলত ধর্ম আমার কাছে ঈশ্বর বিজ্ঞান বা দার্শনিকতা। প্রায় পাঁচ, ছয় হাজার বছর পূর্বে সিন্ধু নদের তীরে ঋষিকুল যজ্ঞাগ্নির চারপাশে গোল হয়ে বসে এরুপ জিজ্ঞাসায় ব্রতী হয়েছিলেন- ‘আমরা কে, আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমরা কোথায় যাবো?। সিন্ধুর বিদেশি উচ্চারণে তা ‘হিন্দু ধর্ম’ বলে খ্যাত হয়েছে। তার-ই একটা উপনিষদে মহিলা ঋষি গার্গীর প্রশ্নোত্তরে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য জানাচ্ছেন কিছু গূঢ় তত্ত্ব।
প্রশ্ন. ১- ঈশ্বরের স্বরুপ কী?
উত্তর- সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতম হলো ঈশ্বরের স্বরূপ। যেমন বরফের সুক্ষ রুপ জল, জলের সুক্ষ রুপ বাষ্প, এরূপ যতো সুক্ষ্ম তুমি কল্পনা করতে পারো গার্গী।
প্রশ্ন. ২- ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন?
উত্তর- তিনি স্বয়ম্ভু, অর্থাৎ আপনাতে আপনি সৃষ্ট। গার্গী এ নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশায় পড়লে যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর – ‘নিত্য কি জিনিস তুমি বোঝনি গার্গী, নিত্যর কখনো জন্ম হয় না’।
প্রশ্ন. ৩ – ঈশ্বর দুই না কেন?
উত্তর- দুই কখনো অনন্ত হতে পারে না।
তবে সৃষ্টি ও স্রষ্টা বিষয়ের দুটো দিক। একটা হলো ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো। যার কোন সীমা পরিসীমা নেই, তাতে অনেক অন্ধ বিশ্বাসও প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের উচ্চতম সার লৌকিক স্তরে নানা প্রতীকে আনুষ্ঠানিকতায় রূপায়িত হয়েছে। আর এগুলো ঘিরে ধর্ম ব্যবসায়ীরা সামপ্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উদ্ভব ঘটিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার বানিয়েছেন নানা অপকৌশলে। যা লক্ষ্য করে ক্ষুব্ধ নজরুল লিখেছেন বহু কালজয়ী কবিতা। বিচলিত রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছেন- ‘এরা নিজ ধর্ম পালন করে ক্ষান্ত হয় না, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত হয়। যে কারণে এক এক ধর্ম বিশ্বাসের অনুসারীরা পৃথিবীর মাত্র ৬০/৭০ বছরের জীবনে পাশাপাশি বাস করতে থাকা অন্য ধর্মের জনগোষ্ঠীকে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, ভিটেবাড়ি, দেশত্যাগে বাধ্য ও উপাসনালয় ধ্বংসের মতো বর্বরোচিত অধর্ম কর্মে প্রবৃত্ত হয়।
যদিয়ো ধর্মের সত্য প্রতিষ্ঠা তার উপলব্ধিতে। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যে কী তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রামকৃষ্ণ যেমন উদাহরণ টেনেছেন- ‘নুনের পুতুল একবার সমুদ্র মাপতে গিয়েছিল, যেই নামা অমনি গলে যাওয়া। কে আর কার খবর দেবে’?
আচার্য প্রভুপাদ কৃষ্ণ ভাবামৃত আলোচনায় পরমার্থের স্বরুপ উদঘাটন করছেন এভাবে- ঐব রং ংসধষষবৎ ঃযধহ ংসধষষবংঃ, নরমমবৎ ঃযধহ নরমমবংঃ, ঐব রং রিঃযড়ঁঃ, ঐব রং রিঃযরহ.
কাজেই এই দুর্লভ মনুষ্য জীবনে স্রষ্টাকে পাবার সাধনায় মগ্ন থাকার কথা সকল ধর্মে জোরালো ভাবে উক্ত হয়েছে। লোককবির প্রিয়ানুরাগ বয়ানে- ‘এমন মানব জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা’ কিংবা ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ ইত্যাদি। শুধুমাত্র আহার, ঘুম, কামাচার ও ভয় প্রবৃত্তি রত পশু আচরণ ‘অমৃতস্য পুত্র’ মানব সন্তানের পাথেয় হতে পারে না। সুতরাং ধর্ম শাস্ত্র জানার প্রধান তাগিদ আসে বিশ্ববিধাতার অনুসন্ধান ও অনুকম্পা পেতে। সকল ধর্ম পড়া হলে এই মূল উদ্দেশ্য প্রতিভাত হয়। শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক অসংখ্য টেঙট বই ও পুস্তকাদি পড়ে যেমন কোন কোন ভাবার্থ বেশি বোধগম্য হয়েছে আমার নিকটে, এও যেন তদ্রুপ। পৃথিবীর সকল মহান ধর্ম এভাবে স্রষ্টার আনুগত্য লাভের দিশারা এনেছে। জগতের সকল ধর্ম বিশ্ব ইতিহাসের সম্পদও বটে। অতএব ধর্মে কোন বিভেদ নেই, ছোট বড়ো কোন পার্থক্য নেই। চট্টল মনীষী মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী যেমন দৃপ্ত উচ্চারণে বলেছেন- ‘ধর্ম একটা, তার বাইরে যা কিছু তাই অধর্ম’।
‘যে দেবী সর্বভূতে মাতৃরূপে বিরাজমান, তাঁকে নমস্কার করি’- ঋষি কবির এমন অপূর্ব স্তোত্র গাথায় দুর্গা পূজার সূচনা। উদার মানবতাবাদে দীক্ষিত হাজার বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বাঙালি সর্বজনীন এ মিলনোৎসবে নিরাপদ স্বাস্থ্য বিধি মেনে আনন্দঘন চিত্তে মেতে উঠুক- এ প্রত্যাশা রইলো
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল