জুলাই ছাত্র বিক্ষোভ ও ৫ আগষ্ট ছাত্র–জনতার বিস্ফোরণ একটি বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। ছাত্রদের অনুরোধে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের কোন বিধান বর্তমান সংবিধানে নেই। এরপরও সরকারটির মেয়াদ তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সরকার সামনে যতদিনই থাকুক’ এটি এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যাবে খন্দকার মোশতাক সরকারের মতোই। খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান করে খন্দকার মোশতাককে সেইফ এক্সিট দিলে সরকারটি বৈধতা পেয়ে যায় এবং খন্দকার মোশতাকের কলম দিয়েই খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। অতীত প্রেক্ষাপট হলো নব্য স্বাধীন এ রাষ্ট্রে তখন পুঁজিবাদী বিকাশ সবে শুরু। ক্লাসিকাল অর্থনীতির ইলিমেন্টারী কনসেপ্ট হলো লুটপাট ছাড়া বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পুঁজিপতির সৃষ্টি সম্ভব নয়। পকিস্তান আমলের সমস্ত কল কারখানা, ব্যাংক, বীমা জাতীয়করণ হওয়ায় এবং সেগুলোতে লুটপাটের মাধ্যমে বছর তিনেকের মধ্যে লুটপাটের ফলে উঠতি লুটেরাদের হাতে কিছু অর্থ এসে যায়। এখন এদের দরকার মিল কারখানার মালিক হওয়া। গ্রামীণ জনপদে ঠিকাদার, বড় ব্যবসায়ী, গাড়ির মালিক, চা–বাগানসহ বহু কিছুর মালিক হওয়া। এ প্রশ্নে প্রথম বাধা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাকশাল বাস্তবায়িত হলে এদেশের বর্তমান ধনিক শ্রেণির বর্তমান রূপ অবশ্যই বেশ কিছু সময়ের জন্য থমকে যেতো। উঠতি ধনিক শ্রেণি রাজী ছিল বলেই মোশতাক বৈধতা পেয়েছিল। খালেদ মোশারফ ও জিয়াউর রহমান ছিলেন উছিলা মাত্র। কার হাতে ক্ষমতা থাকবে এ নিয়ে ছিল দু’জেনারেলের ও তাহেরের মধ্যে রশি টানাটানি। বর্তমানেও ধনিক শ্রেণি বছর পাঁচেক আগে নিপতিত হওয়া সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বীমা কলকারখানা চা–বাগান সহ প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান আত্মসাৎ সম্পন্ন করে একটি ছোট আকারের ধনিক শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটার চূড়ান্ত ব্যবস্থা সম্পাদিত হয় জেনারেল এরশাদের হাত ধরে। এরপরের ইতিহাস এদেশে ধনিক শ্রেণির সুবর্ণ সময়ের ইতিহাস। নব্বইয়ের দশক থেকে কৃষি, মৎস্য, সিমেন্ট, সিরামিক, টিম্বার, চা ও পোশাক শিল্পে শুরু হয় বিপ্লব। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমতে থাকে ব্যাংকে। এর সাথে যোগ হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। ছোট মানের এসব ধনিরা নতুন ফন্দিতে নেমে পড়লো। শিল্প কারখানা, গার্মেন্টস্, হ্যাচারী, শীপ ব্রেকিং সহ নতুন নতুন শিল্প প্রজেক্ট নিয়ে হাজির হল ব্যাংকে, বেশির ভাগ জাল দলিল অথবা ওভার ভ্যালুড করে ঋণের নামে নিয়ে গেল হাজার হাজার কোটি টাকা। ব্যতিক্রমী সৎ ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আছেন এবং এদের কারণে এখনো ব্যাংক, আমদানী, রফতানী ও গার্মেন্টস্ সহ শিল্পকারখানা টিকে আছে। খেলাপী ঋণগুলো ব্যাংক কর্মকর্তা ও অসাধু ঋণ গ্রহীতাদের এক চমৎকার অসাধু ঋণ প্রক্রিয়ার অবধারিত ফসল।
এবার এরা নতুন চেহারায়, নতুন রূপে আবির্ভূত হল। এর শুরু মূলত ২০০১ সালের ৪ দলীয় জোট সরকার ও ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ জমানায়। দলে দলে যোগ দিল বিএনপি ও আওয়ামীলীগে। জীবনভর রাজনীতি করে উঠে আসা নেতাকর্মীদের সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে সংসদে ঢুকে গেল এসব ঋণ খেলাপীরা। দলীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পদবী দখল করল এসব ঋণ খেলাপীরা। আওয়ামীলীগ আমলে দেখা গেল হাতে গোনা কয়েকজনের খেলাপীর ঋণ দাঁড়ালো লক্ষ কোটি। এবার এরা দখল করা শুরু করল ব্যাংক। অভিযোগ হলো এস আলমের নিকট থেকে ঋণ উদ্ধারের পরিবর্তে তুলে দেয়া হয়েছে ৮টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদে বসানো হয়েছে নতুন নতুন মুখ। একপর্যায়ে দেখা গেল ব্যাংক মালিকদের মধ্যে কামড়াকামড়ি সব বেসরকারি ব্যাংকেই ছড়িয়ে পড়লো। অর্থনীতির ভাষায় এর নাম পুঁজিবাদী বা ধনবাদী সংকট। ৫ আগস্ট ছাত্রদের গণবিস্ফোরণের মুখে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন না ঘটলেও অন্য কোনো কারণে অন্য কোনো তারিখে পতন ছিল অবধারিত। কারণ ব্যাংক মালিক, শিল্প মালিক, আমদানী রপ্তানীকারক ও ব্যবসায়ীরা পরষ্পর বাজার, ব্যাংক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে পরষ্পরের মাঝে ঝগড়া বা বিতণ্ডা বা দলাদলিতে এমন সংকটের সৃষ্টি করল যে আওয়ামীলীগ সরকার এগোতে পারছিল না। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে প্রকাশ্যে এল। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া সে চলেই না। এর নাম বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংকট। এ ধরনের সংকটজনক অবস্থায় সামনে আসে কালমাক্সের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রসঙ্গ অথবা কেইনসীয় ফর্মুলায় ধনতান্ত্রিক সংকট উত্তরণ।
লেনিন বলেছিলেন রুশ ধনিকশ্রেণি নিজেদের মধ্যে যে সংকট সৃষ্টি করেছে তার সুযোগ নিয়ে বিপ্লবের এটাই উপযুক্ত সময়। সেনাবাহিনীকে সামনে নিয়ে লেনিন ৭ নভেম্বর ১৯১৭ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্যের সাথে সংঘটিত করে ইতিহাস বদলে দিলেন। বাংলাদেশে জুলাই’ ২৪ এর বিক্ষোভ যদি লেনিনের মতো কোনো নেতার আহ্বানে হতো এবং যদি সমাজ পরিবর্তনের ডাক দেয়া হতো তবে তা বিপ্লবী হবার সম্ভাবনা ছিল। গোটাপৃথিবীতে ওরকম কোনো মার্ঙবাদী বিপ্লবী পার্টি ও বিপ্লবী নেতার অস্তিত্ব আজ আর নেই। আরব বসন্তে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শাসক পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্র বা সরকার বা শোষণ কাঠামোর কোনোটাই পরিবর্তন হয়নি। তিউনিসিয়ার বু–আজিজির আত্মত্যাগ ষোল আনাই বৃথা গেছে। ছেলেদের রক্ত নব্বুইয়ের মতো বৃথা যাবার লক্ষণ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ত্রিমাত্রিক সংকট সবসীমা অতিক্রম করেছে। দুর্নীতি, ব্যাংকিং নৈরাজ্য ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করে রাষ্ট্রকে অচলাবস্থায় নিক্ষেপ করেছিল। অর্থনীতির ভাষায় ব্যাংক মানে গরীব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের টাকায় বড় লোকদের পোদ্দারী। একপর্যায়ে তথাকথিত ব্যাংক মালিকরা মারামারি হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। এস আলমকে ৮/১০ ব্যাংক তুলে দেয়া কোনো যুক্তিতে সমর্থনযোগ্য ছিল না। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল ব্যক্তি খাতের উপর শেখ হাসিনা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। দুর্নীতির ব্যাপারে শুধু এটুকু বলা যায় সরকার দলীয় নেতা, আমলা, পুলিশ ও ঠিকাদার ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির উল্লাসে মত্ত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছিল শেখ হাসিনা, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ লীগের আতি পাতি গর্জে ওঠা লীগের নামে। এতো হাইব্রীড আতিপাতি নেতা বা লীগকে নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা আওয়ামীলীগের ছিল না।
এই লুটপাট হলো ক্ষমতাসীন ধনিকশ্রেণির পারস্পরিক ঝগড়া বা আভ্যন্তরীণ সংকট। এর বাইরে আওয়ামী ধনিক শ্রেণির সাথে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামাতী ধনিকদের দ্বন্দ্বতো ছিলই। বর্তমানে ৫২টি ব্যাংক। শত শত গার্মেন্টস্, শীপ ব্রেকিং, সিমেন্ট, স্টীল সহ হরেক রকমের শিল্প কারখানার মালিক হয়েছে আওয়ামী বড়লোকেরা। ধারে কাছে ঘেষতে দেয়া হয়নি বাকীদের। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী বিরোধী বড় লোকরা অসহিষ্ণু ও অস্থির হয়ে পড়েছিল। কোটা আন্দোলনকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন অতঃপর এক দফা আন্দোলনে পরিণত করার মূল কুশীলব আওয়ামী বিরোধী ধনিক শ্রেণি। ছাত্রদের পেছনে শক্তি যুগিয়েছে দুর্নীতি বিরোধিতা, ব্যাংকিং নৈরাজ্য বিরোধী ও আওয়ামী স্বেচ্ছাচারিতা বিরোধী ধনিক শ্রেণি।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সমাজ, সরকার ও অর্থব্যবস্থা অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়। বিদ্যমান শোষণ ভিত্তিক শাসন টিকিয়ে রাখতে হলে অন্তবর্তী শাসন নামক ব্যবস্থা জারী করে ধনিক শ্রেণি সংকট আপাত; উত্তরণে সক্ষম হয়েছে। ইউনূস স্যারের সরকারকেও নিকট ভবিষ্যতে বিদেয় করে দেয়া হবে। গদি দখল করবে হয় বুর্জোয়ারা। কেইনসের ফর্মূলা অনুযায়ী সরকারি অধিগ্রহণ বা অর্থায়ন ছাড়া দেউলিয়া ১০ ব্যাংককে বাঁচানো যাবে না। ইউনূস স্যার ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দীন আহমদ সাহেবের মতে বাজার কাজ করছে না ও বিশৃঙ্খল বলে মূল্যস্ফীতি চরমে। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া বেসরকারি শিল্পখাত ও বাজার ব্যবস্থা ভারসাম্যে আনা অসম্ভব। দেখা যাক অর্থনীতির বিশ্বনন্দিত অধ্যাপক প্রফেসর ইউনূস বুর্র্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই সংকট কীভাবে সামাল দেন।
লেখক: আইনজীবী, আপীলবিভাগ; কলামিস্ট