দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বর্তমান সময়ের সবচাইতে আলোচিত বিষয়। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। নিত্যকার জিনিসের দাম যেভাবে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে তাতে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়ছে। এদেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া হচ্ছে একটু স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন। এর ব্যত্যয় হলে সাধারণ মানুষ যেকোনো সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হতে বাধ্য। সাধারণ জনগণ রাজনীতির অত মারপ্যাচ বোঝে না, তারা বোঝে যে সরকারই থাকুক তাদের আয়ের সাথে ব্যয়ের যেন সংগতি থাকে। কিন্তু সে স্বপ্ন যখন ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে সেখানে আর যাহাই হোক জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যায় না। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা এখনই দরকার। বেশ কয়েক বছর আগে করোনা মহামারির ধাক্কায় অনেক লোকের চাকুরি চলে গেছে। তারা এখনো জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করছে। করোনা মহামারির ঘাটতি মেটাতে অনেকের বেতন ভাতা সেভাবে বাড়ানো হয়নি এবং দেশের নানা সেক্টরে চাকুরিজীবীদের দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির অনুপাতে বেতনভাতা মোটেও বাড়েনি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম। এভাবে যদি জিনিসপাতির দাম বেড়েই চলে তাহলে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখা কঠিনই হবে।
দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে কী রকম বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা উপলব্ধি করার জন্যে টিসিবির পণ্যের গাড়িতে কিংবা ওএমএসের পণ্যের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের দীর্ঘ লাইনের দিকে দৃষ্টি দিলেই অনুধাবন করা যায়। অনেকেই লোকলাজ ত্যাগ করেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন সকাল থেকেই। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির অনেক কারণের কথা আমরা প্রতিনিয়তই শুনি। কিন্তু সে কারণগুলো বারবার চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তার সমাধান যেন সুদূরপরাহতই থেকে যায়। যার কারণে সাধারণ জনগণকেই প্রতিনিয়ত তার খেসারত দিতে হয়। ব্যবসায়ে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে; কিন্তু সে নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কথা শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, আন্তরিকতার সহিত কেউ তা অন্তরে ধারণ করেন বলে মনে হয় না। ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম একটি বিলি বণ্টন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। পণ্য শুধু উৎপাদন হলেই হয় না, এখানে বণ্টন প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক হাত ঘুরে একটি পণ্য উৎপাদকের কাছে থেকে ভোক্তার নিকট পৌঁছায়। মাঝখানে আছে নানা ধরনের পক্ষ। এখন আমাদের দেশে দ্রব্য মূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির কারণ এক অন্য পক্ষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছে না। পরস্পর দোষারোপের এই সংস্কৃতি সাধারণ ভোক্তার জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের যে প্রশ্ন এই প্রযুক্তি ও সমাজ পরিবর্তনের যুগে আলোচিত হয় তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এখানে ব্যবসায়িক যে মূল্যবোধ নিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা বিষয়ে ভালো মন্দ চিন্তা ভাবনা, ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বিষয়ে আদর্শিক মানদণ্ড, মতামত এগুলো নিয়েই স্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা একটি ধারণার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। সেই মূল্যবোধের চর্চা থেকেই ব্যবসায়ীরা ক্রমেই সরে যাচ্ছে। এখানে পণ্য উৎপাদন থেকে সর্বশেষ ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছা পর্যন্ত সকল পক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকা রয়েছে। কোনো এক পক্ষের অসততার দায় সকলেই নিতে হচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমাগত দোষারোপের সংস্কৃতি। ব্যবসায়িক মূল্যবোধের সর্বজন স্বীকৃত অনেক ধারণার মধ্যে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি না করা, একচেটিয়া ব্যবসায়ের প্রবণতা ত্যাগ করা, সরকারি রীতিনীতি ও দেশে প্রচলিত আইন কানুন যথাযথভাবে মেনে চলা অন্যতম। কিন্তু এ মূল বিষয়গুলো ব্যবসায়ীদের কাছে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অত্যধিক হারে মুনাফা লাভের আসক্তি, অবৈধভাবে যে কোনো পণ্যের মজুত বৃদ্ধি, ন্যায়সংগত ও নির্ধারিত মূল্য নির্ধারণ না করা, বাজার তদারকিতে অনীহা ইত্যাদি কারণে দ্রব্যমূল্যের বাজার লাগামহীন ভাবেই বেড়ে চলেছে। তবে এই বিষয়গুলোর সঙ্গে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও সময়ে সময়ে গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের সংকটও বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হয়ে যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিদিন বাজার ব্যবস্থা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রচারিত হতে দেখা যায়। সাধারণ ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া শুনলেই বোঝা যায় মানুষ এ নিয়ে ভীষণ অসন্তোষের মধ্যে আছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোও মাঝে মাঝে দ্রব্যমূল্যের সামপ্রতিক হালচাল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। ১৪ অক্টোবর ২০২৪ এর প্রথম আলোর ‘নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয় ময়দা, চিনি, সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। টিসিবি এর হিসাব মতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব পণ্যের দাম ১ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ বেড়েছে এবং অন্তবর্তী সরকারের গত দুই মাসে নিত্যপণ্যের দাম কমেনি; বরং বেড়েছে। বর্তমান সময়ের আলোচিত সবজির দাম নিয়ে ১৫ অক্টোবর ২০২৪ এর ‘সবজির সরবরাহ কম, দাম বাড়ে হাতবদলে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তথ্য উপাত্ত দিয়ে বলা হয়, কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সবজির চড়া দামের কারণ সরবরাহ ঘাটতি ও বারবার হাতবদল এবং সরজমিন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বলা হয় বগুড়ার মহাস্থান হাট হতে ঢাকার কারওয়ান বাজারে পণ্য আসতে আগে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হতো। এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। চাঁদা আদায়ের কোনো তথ্য না পাওয়া সত্ত্বেও সবজিগুলোর দাম বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে নামার মধ্যরাতেই পাইকারি পর্যায়ে দেড়গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় পট পরিবর্তন হলেও অদৃশ্য এক সিন্ডিকেট বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই নিয়ন্ত্রণ ভাঙার পদক্ষেপ নিতেই হবে। উৎপাদনের উৎস থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত অনেক পণ্য বণ্টনের যে স্তর সেখানে দেখা যায় উৎপাদনকারী ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না; অথচ ভোক্তাকে অনেক বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। বিপণন ব্যবস্থার দুর্বলতায় সাধারণ মানুষ কষ্ট ভোগ করছে। এই বিপনন ব্যবস্থার মধ্যে যে দুর্বলতা তা সরকারকে দূর করতে সরকারকে অগ্রাধিকার দিয়েই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, কলেজ শিক্ষক।