বাংলাদেশ স্তব্ধ। নির্বাক। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় সারাদেশের বিবেকবান মানুষ ক্ষুব্ধ। এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন সবাই। ঘটনার পেছনে ত্রুটিপূর্ণ পারিবারিক শিক্ষা, নারীকে হীন করে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনেক সময়ই ঘটনার সুষ্ঠু কোনো বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বিব্রত করার ষড়যন্ত্র বলে অনেকে মনে করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিন্দনীয় এ ঘটনার পেছনে দায়ী সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, যথাযথ শিক্ষার অভাবসহ মাদকের মতো বেশ কিছু বিষয়। তাঁদের মতে, এ ঘটনার বিস্তার রোধে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার এই অপরাধীদের এবং শাস্তির বিষয়গুলোও প্রচার করা দরকার গণমাধ্যমে, যাতে কেউ এই ধরনের হীন কাজ করার দুঃসাহস আর না দেখায়। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ, বিদ্যালয়ের মতো জায়গাগুলোতে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার করা উচিত। এছাড়া লিফলেট, ব্যানার-পোস্টারের মাধ্যমেও সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো উচিত।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটছে। ধর্ষণের সঙ্গে সহিংসতা, হত্যা ও নির্মমতাও বাড়ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ধর্ষণের যারা শিকার হন তাদের শতকরা ৫০ ভাগ শিশু। এই শিশুদের অর্ধেকের বয়স ১২ বছরের নিচে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এই ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে না। যেসব ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তার ২০ ভাগের বেশি থানায় মামলায় হয় না। শতকরা এক ভাগের বেশি শাস্তি হয় না। বিচারহীনতা এবং ভয়ের সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, অনেক ধর্ষক আটক হন। কিন্তু তাদের তেমন কোনো বিচার হতে দেখা যায় না। অনেক সময় আবার আইনের বিভিন্ন ফাঁক-ফোকরে বেরিয়ে যান অনেকে। এ ক্ষেত্রে দোষীরা অনেক সময়ই পার পেয়ে যান। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত এসবের বিচার হওয়া দরকার। বিচার না পাওয়ায় এখন অনেকেই আর মামলা করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। আর ভয়ের কারণেও অনেকে মামলা করতে পারছেন না। সাহস পাচ্ছেন না। ক্ষমতা আর বিত্তের কাছে বিচার প্রার্থীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন। আর যারা অপরাধী, তারাও জানে যে তাদের কিছু হবে না। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ঘৃণার সংস্কৃতি। এমনভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়া হয় যে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নেন। বিচার চান না।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, অপরাধীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মাদক চক্র, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছত্রছায়ায় থাকার কারণে তারা বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। নারীর প্রতি একের পর এক সহিংস ঘটনার পেছনে বড় কারণ হিসেবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না ওঠাকে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তদন্ত প্রক্রিয়া, আদালত থেকে শুরু করে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থায় যে দুর্বলতা আছে, সেটাকে শক্তিশালী না করলে, বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি না ভাঙা পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। এছাড়া বিকল্প উপায়ে এই অপরাধীদের সংশোধনের সুযোগও বাংলাদেশে অনেক কম। সমাজ থেকে নারীকে দমন করা বা অসম্মান করার মানসিকতা দূর করা না গেলে এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা বারবার ঘটবে। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো দরকার। তবে আইনের শাসন না থাকলে পারিবারিক শিক্ষাও কাজ করবে না বলে মনে হয় না।
আসলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সবাইকে হতে হবে সচেতন। সমাজের সবাইকে এক হয়ে এ ধরনের হীন কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সমাজের সবাই সচেতন হলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। পাশাপাশি দোষীরা যাতে শাস্তি পায় সে দিকটাও নিশ্চিত করতে হবে।