প্রতিদিন গড়ে পঞ্চাশ হাজার টন জ্বালানি তেল খালাসের অভাবনীয় এক স্বপ্ন বাস্তবায়নের একেবারে দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে জাহাজ থেকে ৬ দিনে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল খালাস করা হয় তা মাত্র ১দিনেই করা সম্ভব হবে। ছয় হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে জ্বালানি তেল খালাসের লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পটির কাজ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে। এতে জ্বালানি তেল লাইটারিং-এ বছরে অন্তত ৮শ’ কোটি টাকার খরচ সাশ্রয় হবে। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেয়া কয়েকটি প্রকল্পের একটি হিসেবে গভীর সমুদ্রে বাস্তবায়নাধীন ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে অবস্থানকারী এক লাখ টন ধারণক্ষমতার মাদার ট্যাংকার থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা হবে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে গড়ে ৭০ লাখ টনের কাছাকাছি জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। এরমধ্যে ১৫ লাখ টনের মতো ক্রুড অয়েল এবং বাকিটা পরিশোধিত অবস্থায় বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল নিয়ে বিশালাকৃতির মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। গড়ে ১ লাখ টন ধারণক্ষমতার বিশালাকৃতির এসব অয়েল ট্যাংকার কুতুবদিয়ার অদূরে অবস্থান নেয়। ওখান থেকে এসব জ্বালানি তেল লাইটারিং করে ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং গুপ্তাখালস্থ প্রধান ডিপোতে নিয়ে আসা হয়। এই খাতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) বছরে গড়ে ৮শ’ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। অপরদিকে ১ লাখ টন জ্বালানি তেল লাইটারিং করতে গড়ে ১১ থেকে ১২দিন সময় লাগে। এক একটি মাদার অয়েল ট্যাংকারকে বসিয়ে বসিয়ে ১১/১২দিনের ভাড়া পরিশোধ করতে হতো। এতেও বিপিসিকে বড় অংকের টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া মাদার অয়েল ট্যাংকার থেকে লাইটারেজ করার সময় জ্বালানি তেল অপচয়, নষ্ট হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, বহু তেল চুরিও হয়। এভাবে বিপিসি প্রচুর সিস্টেম লজের কবলে পড়ে।
উপরোক্ত সংকট থেকে উত্তোরণ, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সর্বোপুরি অবস্থায় জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলে ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন সরকার আগ্রহ দেখায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চীনের এঙ্মি ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তায় ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপ লাইন’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় চায়না পেট্রোলিয়াম ব্যুরো মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নির্মাণ করবে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফ শোর এবং অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। এরমধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন। বর্তমানে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। কঙাবাজারের মহেশখালী এলাকায় ৯০ একর জায়গার উপর ৬টি স্টোরেজ ট্যাংক ও পাম্প স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ৬টি স্টোরেজ ট্যাংকের ৩টিতে পরিশোধিত এবং অপর ৩টিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুদ করা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার এবং অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার। জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল ও পরিশোধিত তেল সরাসরি ভেসেল মুরিং পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখান থেকে পাম্প করে পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে পুনরায় পাম্পের মাধ্যমে পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হবে। ডাবল পাইপ লাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল এবং অপর পাইপ লাইন দিয়ে রিফাইনড অয়েল সরবরাহ দেয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল খালাস করা যাবে বলেও বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পটির কাজ আরো অনেক আগে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত তিন দফা সংশোধন করে আগামী বছরের (২০২৩ সাল) জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। সময় বাড়ার সাথে সাথে প্রকল্পটির ব্যয় ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীনে কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। তখন পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত মিলে এই প্রকল্পটির মাধ্যমে বছরে ৯০ লাখ টন জ্বালানি তেল বহির্নোঙর থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিবহন করা যাবে।
বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় বহির্নোঙর থেকে জ্বালানি তেল খালাস করা হয় তা গতানুগতিক একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ, ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুলও। গভীর সমুদ্রে মুরিং পয়েন্ট নির্মাণ এবং পাইপ লাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস সর্বাধুনিক পদ্ধতি বলেও তারা মন্তব্য করেন। এতে শুধু সময় এবং অর্থই সাশ্রয় হবে না, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে বলেও তারা উল্লেখ করেন।