দৈনিক আজাদী ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস

আমিনুর রশিদ কাদেরী, প্রাবন্ধিক | বৃহস্পতিবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক আজাদীর সঙ্গে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসএর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। আজাদীর জন্মলগ্ন থেকেই তিনি আজাদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি যখন নোবেল পুরস্কার পান, আজাদী তখন শিরোনাম করেছিল ‘আঁরার ইউনূস নোবেল পাইয়্যে’। শিরোনামটি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসএর এতো বেশি পছন্দ হয়েছিল যে, দৈনিক প্রথম আলো যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যায়, তখন তিনি শর্ত জুড়ে দেন যে, যদি দৈনিক আজাদী হাতে নিয়ে দেওয়া পোজের ছবি সাক্ষাৎকারের সাথে ছাপাতে হবে। দৈনিক প্রথম আলো দৈনিক আজাদীর ওই সংখ্যাটি প্রদর্শন করে দেওয়া পোজের ছবিটি ছাপিয়েছিল।

আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে দৈনিক আজাদীর সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি সেই অনুষ্ঠানে আজাদী সম্পর্কে বলেছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা। আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক সম্পাদিত ‘৬০ বছরের আজাদী’ শীর্ষক গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এতে তিনি লিখেছেন :

আজাদীর কথা ভাবলে মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের কথা মনে পড়তেই হবে। কী সব অসম্ভব তাঁর উদ্যোগ। বইয়ের দোকান। তারপর ছাপাখানা। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। শিশুদের জন্য পত্রিকা প্রকাশ। কোহিনূর। তারপর লাগলেন চট্টগ্রাম থেকে একটা মানসম্পন্ন দৈনিক পত্রিকা বের করা নিয়ে। সত্যি সত্যি দৈনিক। চট্টগ্রাম থেকে অনেক আগে থেকে দৈনিক পত্রিকা বের হতো। নাম ‘দৈনিক’ হলেও কালেভদ্রে একটা ‘গরম খবর’কে কেন্দ্র করে হঠাৎ হঠাৎ করে বের হতো। একটি দৈনিক পত্রিকা বের হতো বছরের মাথায় একবার শুধু ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার জন্য।

দৈনিক আজাদীর লক্ষ্য ছিল রোজ ভোরে বাসায় বাসায় দোকানে দোকানে এটা পৌঁছানো বছরের প্রতিটি দিন। আজাদী জন্ম থেকে আজ অবধি সে ওয়াদা পালন করে যাচ্ছে। তার সঙ্গে মুদ্রণ জগতে যত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এসেছে সেগুলো কাল বিলম্ব না করে গ্রহণ করে গেছে আজাদী।

তখন ঢাকা থেকে পত্রিকা আসতো একদিন পর। সংবাদের জন্য ঢাকার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করে চট্টগ্রামবাসীর কাছে টাটকা খবর পৌঁছানোর দায়িত্ব নিলো আজাদী। যে খবর ঢাকার কাগজ থেকে একদিন পরে পাওয়া যাবে সেটা আজকেই পেয়ে যাওয়াএটা একটা বিরাট পাওয়া। কিছুদিন পর ঢাকার কাগজ যেদিনের কাগজ সেদিন চট্টগ্রাম আসা শুরু করলো। কিন্তু পৌঁছাতো অনেক দেরিতে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাওয়া যেতো আজাদী। আজাদীর কদর কমলো না। আমার সঙ্গে আজাদীর একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ষাটের দশকের শুরুতে। আমাকে অনুরোধ করলো একটা কলাম লেখার জন্য। তখন আমি চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক। আমিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। ‘হিং টিং ছট’ নামে একটা কলাম লিখে গেলাম কিছুদিন ধরে।

চার দশক জুড়ে একটানা আজাদীর সম্পাদনা করে গেছেন প্রফেসর খালেদ। তিনি এবং আজাদী সমার্থক হয়ে পড়েছিল। তাকে ছাড়া আজাদী চিন্তাই করা যেতো না। তিনি আমাদের সবার প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আমার সকল উদ্যোগের পেছনে আন্তরিক সমর্থন যুগিয়ে গেছেন। তিনি আমার সকল কাজে উৎসাহ সহকারে সঙ্গ দিতেন।

আমাদের সকল সভায় আমরা তাঁকে সভাপতি করে নিয়ে আসতাম। প্রফেসর খালেদের পর সম্পাদনার দায়িত্ব এসে পড়লো মালেকের ওপর। মালেকের সঙ্গে আমার এবং আমার ভাইদের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকে। আজাদীকে গোড়া থেকেই মালেক, তার পরিবারের একজন সদস্য হিসেবেই গণ্য করে এসেছে। কখনো আজাদী তার কাছে পরিবারের মুরব্বি, কখনো তার সন্তান। কিন্তু কোন সময় ভুলে নাই যে আজাদী তার পরিবারের গৌরবময় ঐতিহ্য। আজাদীকে তার পারিবারিক ঐতিহ্যকে ছাড়িয়ে চট্টগ্রামবাসীর ঐতিহ্যে পরিণত করতে পেরেছে মালেক।

এই ঐতিহ্য অব্যাহত থাকুক। এই ঐতিহ্য ক্রমাগতভাবে সমৃদ্ধ হোকআজ আজাদীর জন্মদিনে দেশবাসী, বিশেষ করে চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই কামনা করছি।’

গত ৮ই আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পরদিন আজাদীতে সম্পাদকীয় লেখা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘অভিনন্দন জীবন্ত কিংবদন্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আপনার নেতৃত্বে সফল হোক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। এতে বলা হয়,

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত হওয়া দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি। অভিনন্দন জানাই প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। যিনি আমাদের গর্ব। সমগ্র বাঙালি জাতির গর্ব তিনি। আলাদাভাবে বলতে হয় তিনি চট্টগ্রামের অহংকার। তিনি শুধু আমাদের অহংকার নন, তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার যে ধারণা প্রবর্তন করেছেন, তা সারা বিশ্বের সামনে এক অনন্য মডেল। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় ড. ইউনূসের বিকল্প হয় না। তাঁর নেতৃত্বকে আমাদের সবাইকে সহায়তা দিতে হবে। আশা করি, দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হবেন। তাঁর নেতৃত্বেই ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রা শুরু হবে।’ আরো বলা হয়, ‘. ইউনূসের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা আছে। আবার তাদের প্রত্যাশাও অনেক। আমরা আশা করছি, . ইউনূসের এ দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অস্থির সময়ের অবসান ঘটবে। দেশ একটা সুন্দর পরিবেশের মাধ্যমে সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাবে। সফল হোক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ড. ইউনূস স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে কাজ করার গৌরব আছে আমার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি ২০০১ সালে একটি বই লিখেছিলাম। বইটির নাম : ‘দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস’। প্রকাশ করেছিল ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থা শৈলী। ২০০৭ সালে তার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

দৈনিক আজাদী যেমন চট্টগ্রামের মুখপত্র, তেমনি ড. ইউনূসেরও প্রিয় পত্রিকা। ৬৫ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে আমরা আজাদীর সর্বস্তরের পাঠক, লেখক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, চাগবেষক; মহাপরিচালক,

চট্টগ্রাম একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাটগাঁর মুখপত্র দৈনিক আজাদীর সাথে আমার সম্পর্ক আত্মীক
পরবর্তী নিবন্ধবৈচিত্র্যে চট্টগ্রাম