দেয়াল ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

যখনই হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করা হয় জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবসে তাঁর সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি দুর্ভাগ্যের মতো দুটো নামও উঠে আসে। গুলতেকিন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু গতানুগতিক পুরুষ সত্তা থেকে হুমায়ূন আহমেদ যেমন বের হয়ে আসতে পারেননি, রবি ঠাকুরও কি বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন? তবু তাঁর সৃষ্টির কাছেই আমাদের আশ্রয়। সুখে-দুঃখে আনন্দ বেদনায় তাঁর কাছেই বারবার ফিরে আসতে হয়। কবিগুরুর সাহিত্যকর্মের জন্য তাঁর পাঠক তাঁকে ঋষি বলেই মানে। তাঁর বিশাল লেখক সত্তাকে অতিক্রম করে কোন পাঠক তাঁর ব্যক্তিসত্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে আগ্রহী নয়। এক্ষেত্রে একেবারে ব্যতিক্রম হুমায়ূন আহমেদ। যদিও কবিগুরুর সাথে হুমায়ুন আহমেদের তুলনামূলক আলোচনার সুযোগ নেই। কোলকাতা নির্ভর সাহিত্যপ্রেমীদের হঠাৎ করে কয়েক দশক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখার মধ্যে বুঁদ করে রেখেছিলেন। কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের উপাখ্যান কিংবা এভাবেও বলা যায় তাঁর লেখায় এই মধ্যবিত্ত সমাজটাকেই তিনি উপজীব্য করে তুলেছিলেন তাঁর গল্পে। তাঁর রচনায় এতটাই জীবনের গল্প উঠে আসতো যে হুমায়ুন আহমেদকে পাঠক তাদের খুব কাছের কেউ ভাবতে শুরু করে। এমন কি তাঁর ব্যক্তি জীবনটাও পাঠকদের প্রভাবিত করতে শুরু করে। তাই তাঁর বিশাল পাঠক সমাজ তাঁর উপর মান অভিমানেও জড়িয়ে পড়ে যখন তাঁর মেয়ের বান্ধবী কিশোরী শাওনকে বিয়ে করেন। আমার স্কুলের এক শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদের ওপর অভিমান করে তাঁর অনেক বই পুড়িয়ে ফেলে। অনেক যত্নে যে-বইগুলো সে সংগ্রহ করেছিলো। অনেক অল্পবয়সী পাঠক সেই সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। প্রিয় লেখকের এমন খেয়ালপনা মেনে নিতে পারেনি।
যাই হোক দীর্ঘদিন হুমায়ুন আহমেদ পড়া হয়নি। তাঁর দেয়াল উপন্যাসটি ২০১৪ বইমেলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক বিক্রি হওয়া বই। এছাড়া এটি তাঁর শেষ উপন্যাস। বইটি প্রকাশিত হবার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এক-এক বয়সে একেকরকম বই পড়তে ভালো লাগে। ইদানীং আত্মজীবনী বা প্রবন্ধের বইগুলো বেশি টানে। গল্প যে একেবারে পড়ি না তা নয়। গত মাসে দেশের বাইরে স্বামীর চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সময় দুটো বই স্যুটকেসে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। একটা অরুন্ধতী রায়ের ‘‘কাশ্মীর, আজাদীর লড়াই’’ অন্যটা হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’। ব্যস্ততার ফাঁকে-ফাঁকে কখনো হোটেলের রুমে, কখনো হাসপাতালের কেবিনে, কখনো আইসিওর সামনে বসে কঠিন সময়গুলো পার করেছি বইগুলোর আশ্রয়ে।
হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ পঁচাত্তরের সেই টালমাটাল সময়টাকে ধারণ করেছে। ঐ সময়ের ইতিহাসকে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। চুয়াত্তর পঁচাত্তরের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, বাকশাল, রক্ষী বাহিনী, ফারুক রশীদের চক্রান্ত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, মোশতাকের ক্ষমতা লাভ, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান, কারাগারে চার নেতার হত্যাকাণ্ড, তাহেরের সিপাহী বিপ্লব, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা লাভ। খালেদ মোশাররফের হত্যাকাণ্ড, কর্নেল তাহেরের ফাঁসির উপাখ্যানের পাশাপাশি অবন্তী নামক এক কিশোরীর জীবনের গল্প ও সমান্তরালে উঠে এসেছে। বাবা-মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়নে মেয়েটা এক সময়ের দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তা দাদা সরফরাজ খানের সাথেই থাকে। হুমায়ুন আহমেদের অন্যন্য গল্পের চরিত্রের মতো মেয়েটাও তার খেয়াল খুশিতেই চলে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নাতনিকে নিয়ে গ্রামে চলে যান। নাতনির নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সরফরাজ খান এক পীরের বাড়িতে রেখে আসেন। পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পীর সাহেব অবন্তীকে নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দেন। অবন্তী এই বিয়ে মেনে নেয়নি কিন্তু তাদের সাথে সম্পর্কও ছিন্ন করেনি। সে তার গৃহশিক্ষক শফিককে ভালোবাসে। সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা ও ক্ষমতার পালা বদলের ইতিহাসের সাথে সাথে অবন্তীর গল্পও টেনে নিয়ে যান লেখকের স্বভাবসুলভ দক্ষতায়। যে কোন বিষয়কে গল্পে রূপ দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা হুমায়ূন আহমেদের।
বইটির ভূমিকা লিখেছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম আখ্যােেন আমরা পরিচিত হুমায়ূন আহমেদকে পাই। চরিত্রের খেয়ালিপনা, সংলাপের সংঘাত, ঘটনার আকস্মিকতা ও কার্যকারণহীনতা আমাদের সবসময় রহস্যময়তার দিকে আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় আখ্যানের ঐতিহাসিকতা প্রমাণের জন্য হুমায়ূন বইপত্র ও মামলার কাগজপত্রের শরণাপন্ন হয়েছে। তবে তারপরও তথ্যগত ত্রুটি রয়ে গেছে।’
এই উপন্যাসের ঘটনার পরম্পরা বাস্তবতারই অংশ। বইটি ইতিহাসের সত্য ও গল্পের বুননে হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যান হয়ে ওঠে। যে সমস্ত পাঠক অকুতোভয় বীরসেনানী খালেদ মোশাররফকে সঠিকভাবে জানতে পারেননি কিংবা যারা কর্ণেল তাহের সম্পর্কে, তাঁর বীরত্ব ও দেশপ্রেম সম্পর্কে অবগত নয় তারা খুব সহজে অনেক কিছু জানতে পারবেন। ইতিহাসের খলনায়কদের ও চিহ্নিত করতে পারবেন। সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষমতালিপ্সা, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সদ্য স্বাধীন দেশটাকে কতটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কি হাল হয়েছে পাঠক খুব সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন।
এই টালমাটাল পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা হারিয়েছি। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি। যার খেসারত জাতি আজও দিয়ে চলেছে। ‘দেয়াল’ হুমায়ূন আহমেদের বর্ণাঢ্য লেখক জীবনের শেষ উপন্যাস। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর চিকিৎসা চলাকালীন সময়ের লেখা। বইটি প্রকাশ করেছে ‘অন্য প্রকাশ’ লেখকের মৃত্যুর পর। হুমায়ূন আহমেদের বই মানে পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবন্দু। সেই অস্পষ্ট সময়ের অনেক কিছু জানার সুযোগ রয়েছে ‘দেয়ালে’। সবশেষে বইয়ের কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিলাম।
“সাতই নভেম্বর খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়, বিপ্লবের নামে অফিসার হত্যার কাজটা সাধারণ সৈনিকেরা করতো। খালেদ মোশাররফের ব্যাপারে এই দায়িত্ব দুজন অফিসার পালন করেন, তারা হলেন ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিল। মজার ব্যাপার হলো এই দুজনকে খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত পছন্দ করতেন ‘কে ফোর্সে’র অধীনে দুজনেই খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন আসাদকে তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন। অসীম সাহসী মুক্তিযাদ্ধা বীর উত্তম খালেদ মোশাররফের মৃতদেহ ক্যান্টমেন্টের রাস্তায় খেজুর গাছের নীচে অপমানে ও অবহেলায় পড়েছিল।”
“কর্ণেল তাহের তার অনুগত সেনাবাহিনীর সাহায্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে সিপাহী বিপ্লবের সূচনা করেন। জেনারেল জিয়া কর্ণেল তাহেরকে জড়িয়ে ধরে আবেগমথিত কণ্ঠে বলেন, বন্ধু, তোমার এই উপকার আমি কোনদিন ভুলবনা। জেনারেল জিয়া কর্ণেল তাহেরের উপকার মনে রেখেছিলেন কিনা তা আমরা জানি না, তবে তিনি যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছিলেন তা আমরা জানি।”
এই উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র অবন্তির জন্যও পাঠক হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। তার বাবা নিখোঁজ মা ইসাবেলা সম্পর্ক ছিন্ন করে তার স্বদেশ স্পেনে ফিরে যায়। চিঠিই তাদেও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তার সেই চিঠি দাদা সরফরাজ খান গোপনে পড়ে দেখতেন। অর্থাৎ কড়া নজরদারিতে রাখার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে গৃহ শিক্ষক শফিকের উপর নজরদারির ব্যাপারটা একটু বেশিই! অবন্তীর জন্মদিনে শফিক একটা বই উপহার পাঠিয়েছিলেন। তারপর- ‘অবন্তীর দাদা সরফরাজ খানের হাতে ইছামতী বই। দারোয়ান বইটা সরাসরি তাঁর হাত দিয়েছে। তিনি প্রথম পাতা উল্টে দেখলেন, লুকানো কোনও চিঠি আছে কী না! বদ প্রাইভেট মাস্টারেরা বইয়ের ভেতর লুকিয়ে প্রেমপত্র পাঠায় এটি অতি পুরনো টেকনিক। চিঠি পাওয়া গেল না। বইটা তিনি ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখেন। আগে নিজে পড়ে দেখবেন বইয়ের লেখায় কোনও ইঙ্গিত আছে কী না। গল্প উপন্যাস হলো অল্পবয়সী মেয়েদের মাথা খারাপের মন্ত্র। তাঁর মতে দেশে এমন আইন থাকা উচিত যেন বিয়ের আগে কোনও মেয়ে আউট বই পড়ত না পারে।’
এই বিষয়টাও আমাদের অপরিচিত নয়। মেয়েদের প্রতি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিবিম্ব। সবশেষে বলা যায় হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ উপন্যাসটি ইতিহাস আশ্রিত হলেও ইতিহাস নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমান্দালের মরুদ্যান পোপা পর্বতে- ১
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনপুরায় চিকিৎসা সেবা ও রক্তের গ্রুপ নির্ণয়