বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে আমরা শোক প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার ও দেশবাসীর প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে জাতি তার এক মহান অভিভাবককে হারাল। তাঁর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত।’ তিনি বলেন, খালেদা জিয়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর অবদান, তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম এবং তাঁর প্রতি জনগণের আবেগ বিবেচনায় নিয়ে সরকার চলতি মাসে তাঁকে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর আপসহীন নেতৃত্বের ফলে গণতন্ত্রহীন অবস্থা থেকে জাতি বারবার মুক্ত হয়েছে, মুক্তির অনুপ্রেরণা পেয়েছে। দেশ ও জাতির প্রতি তাঁর অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও জাতির কল্যাণে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা, গণমুখী নেতৃত্ব এবং দৃঢ় মনোবল সব সময় পথ দেখিয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত রাজনীতিককে হারাল। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিভিন্ন দেশ ও সরকারপ্রধান শোক প্রকাশ করেছেন।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির জন্ম হয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে এক জনপ্রিয় নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলটির পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন খালেদা জিয়া। সেই সঙ্গে তিনিও হতে পেরেছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনে জনপ্রিয়তার এক অনতিক্রম্য রেকর্ড গড়েছেন তিনি। রাজনীতিতে আসার এক দশক পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হয়েছেন। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এটিও একটি তুলনাহীন অর্জন। তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতার বলয়ের ভেতর থেকে তৈরি হওয়া বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার জীবন কাহিনী নিয়ে বই প্রকাশ করেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। তিনি বেঁচে নেই। বইটি প্রকাশের সময় মাহফুজ উল্লাহ বলেছিলেন, অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পর খালেদা জিয়া পুরুষ শাসিত সমাজে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এসে যোগ্যতা দিয়ে নিজের আসন তৈরি করে নেন।
বিশ্লেষকদের মতে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাহসী নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে এদেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছে। নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুদ্ধারে রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহুবার কারাবরণ করেছেন এবং চড়াই–উৎরাই পার করেছেন, কিন্তু নিজের রাজনৈতিক আদর্শ ও জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে থাকবে অনুপ্রেরণা হয়ে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার যে আপসহীন সংগ্রাম সেটাই তাকে একজন অনিবার্য রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের অভিভাবকে পরিণত করেছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে তিনি বিশেষভাবে অনিবার্য হয়ে উঠেছিলেন। দলটির নেতাকর্মীদের কাছেও বেগম জিয়া এক কথায় ‘সিম্বল অব ইউনিটি’। আর দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্ব।
তিনি স্বল্পবাক ছিলেন, ছিলেন দূরদর্শী। তিনি কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য দেননি। জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ ও দৃঢ় অবস্থান দেশের জন্য এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের কোটি কোটি প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।








