দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে বড় চ্যালেঞ্জ অটোমেশন

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে এর বিকল্প নেই অভিমত ব্যবসায়ীদের চীনে কারখানার প্রতিটি ধাপে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, শ্রমিক সংকট কাটিয়ে অভাবনীয় উৎপাদন বৃদ্ধি

হাসান আকবর, হাংজো (চীন) থেকে | শুক্রবার , ১৪ জুন, ২০২৪ at ৭:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে অটোমেশন। রোবটের অকল্পনীয় অগ্রগতি এই সেক্টরে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রাখা কঠিন করে তুলছে। সস্তা শ্রমের সুযোগে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার সুযোগ পায়। অপরদিকে বেশ বড় ব্যবধানে থাকা বিশ্বের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ চীন শ্রমিক সংকট এবং শ্রমের চড়া দামে বেশ বেকায়দায় থাকে। এই দুইটি সংকটের কারণে চীনের বহু শিল্পপতি বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশে বিপুল বিনিয়োগ করে। কিন্তু বিশ্বের কারখানা খ্যাত চীন সেই সংকট দ্রুত কাটাতে শুরু করেছে। শ্রমিকের পরিবর্তে রোবটের ব্যবহার এবং এক একটি মেশিন দিয়ে ৫ থেকে ২০ জন পর্যন্ত শ্রমিকের কাজ সুচারু রূপে সম্পন্ন করার সুযোগ তৈরি হওয়ায় চীন যে সংকটে পড়েছিল সেটা কাটাতে শুরু করেছে। গার্মেন্টস সেক্টরের মেশিনারিজ তৈরিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চীনা প্রতিষ্ঠান জ্যাক একের পর এক আধুনিক মেশিন তৈরির পাশাপাশি রোবটকে কাজে লাগিয়ে চড়া শ্রম এবং শ্রমিকের সংকট থেকে চীনকে মুক্তি দিচ্ছে। চীনের সাংহাই থেকে প্রায় দুইশ’ কিলোমিটার দূরে জেজিয়াংয়ের কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানা সরজমিনে ঘুরে এসব রোবটিক কার্যক্রম দেখা গেছে।

বিশ্বের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বহু বছর ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে চীন। প্রতিবছর বিশ্বের নানা দেশে চীন প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। বছর কয়েক আগে এর পরিমাণ ২শ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। শ্রমিক সংকট এবং শ্রমের চড়া দামের কারণে চীনে বহু গার্মেন্টস কারখানার মালিক ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হন। এই সংকটের কারণে অনেকেই বিদেশে গিয়ে বিনিয়োগ করেন। চীনে বর্তমানে ১৪ হাজারের মতো গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ১ কোটি ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। অপরদিকে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত চীনের থেকে বহু পেছনে। বাংলাদেশ বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও কম তৈরি পোষাক রপ্তানি করে। ৪ হাজারের মতো গার্মেন্টস রয়েছে এদেশে। কাজ করেন ৪০ লাখের মতো শ্রমিক।

রপ্তানি এবং কারখানার সংখ্যার দিকে বাংলাদেশ চীনের এক চতুর্থাংশ। কিন্তু শ্রমিক প্রায় অর্ধেক। চীনের কারখানাগুলোতে ব্যাপক হারে অটোমেশন হওয়ায় কম শ্রমিক দিয়ে তারা বেশি পণ্য উৎপাদন করে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দ্রুত এগুচ্ছে। চীনের শত শত কারখানায় শুরু হয়েছে রোবটিক উৎপাদন। শত শত শ্রমিকের কাজ করছে রোবট, মেশিন। পুরো কারখানা অটোমেশন করায় এদের কাজের গতি যেমন বেড়েছে তেমনি কমে গেছে উৎপাদন খরচ।

বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড জারার শীতের পোশাক তৈরি হচ্ছিল চীনের হাংজো শহরের পাশ্বস্থ জিয়াজিং বেস্টিং ইন্টেলিজেন্ট ম্যানুফাকচারার্স নামের কারখানায়। কারখানাটি ঘুরে অটোমেশনের বিস্ময়কর কার্যক্রম দেখা গেছে। কারখানাটি পুরোপুরি জ্যাক কোম্পানির মেশিনারিজ এবং রোবটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কারখানায় দেখা গেলো, অটোমেটিক মেশিনে কম্পিউটার নির্দেশনায় ব্লেজারের শত শত পিস কাপড় মাত্র কয়েক মিনিটে কেটে ফেলা হচ্ছে। কাটা কাপড়ের পিসগুলো ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে হ্যাঙ্গারে। হ্যাঙ্গারটি নিজে নিজে সামনের দিকে যাচ্ছে। থেমে যাচ্ছে অপারেটরের সামনে। একজন অপারেটর তার জন্য নির্দিষ্ট অংশটি সেলাই করে দেয়ার সাথে সাথে হ্যাঙ্গারটি পরের অপারেটরের কাছে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে আবার পরের অপারেটরে। এভাবে কয়েকটি টেবিল হয়ে শেষ লাইনে এসে পুরো ব্লেজার হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। ফিনিসিং পয়েন্টে সব ঠিক আছে কিনা দেখার পর হ্যাঙ্গারের যাত্রা আয়রন এবং প্যাকেজিং এর দিকে। কারখানাটিতে জ্যাক কোম্পানির অতি বিস্ময়কর এক রোবটের দেখা মিলে। মাঝারি সাইজের স্যুটকেসের মতো দেখতে একটি মেশিন তার অন্তত ছয়গুণ বড় কয়েক তাকের পণ্য বোঝাই র‌্যাক টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওয়্যার হাউজ বা গুদামে। আবার গুদাম থেকে বাইরেও একইভাবে র‌্যাক নিয়ে আসছে। এজিভি ( অটোমেটেড গাইডেড ভ্যাহিক্যাল) নামের মেশিনটি নিজে নিজে লিফট অপারেট করে পণ্য বোঝাই র‌্যাক নিয়ে দোতলা, তিন তলায়ও যাতায়ত করে, করে পণ্য পরিবহন। চীনের জ্যাক কোম্পানির প্রস্তুতকৃত মেশিনটি যে পরিমাণ পণ্য বোঝাই র‌্যাক নিয়ে কারখানার হেথায় হোথায় নিজে নিজে যাতায়ত করছিল সেই র‌্যাকটি বহন করতে কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ জন শ্রমিকের দরকার হতো।

ইউপুফাং নামের অপর একটি কারখানায় গিয়ে দেখা গেল এজিভি’র জয়জয়কার। বছরে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার (চারশ’ কোটি চীনা ইউয়ান) রপ্তানিকারক বেশ বড়সড় কারখানাটির ওয়্যারহাউজ পরিচালনা করছেন মাত্র দুজন তরুণী। ওয়্যারহাউজের ৯ তাক উচ্চতা পর্যন্ত পণ্য উঠানো নামানোর কাজ করছে এজিভি। ডেলিভারি পয়েন্টে ৯টি বিশাল বিশাল কাপড়ের রোল নিয়ে হাজির হলো এভিসি। যা ২০ জন মানুষের পক্ষেও বহন করা অসম্ভব।

অত্যন্ত স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এজিভি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে যা মানুষ দিয়ে করাতে অনেক বেশি সময় লাগতো। চীনের বাজারে মেশিনটির দাম ১৫ হাজার ডলার। একটি কারখানার শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, এই রোবট আমাদের বহু কষ্ট কমিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের কারখানায় বর্তমানে ৫শ’র মতো শ্রমিক কাজ করেন। অটোমেশন না করে সব ম্যানুয়েলি করতে হলে অন্ততঃ দুই হাজার শ্রমিক লাগতো। গার্মেন্টসের কাজ খুব পরিশ্রম এবং দীর্ঘ সময় করতে হয় বিধায় চীনের বহু মানুষই এ কাজ করতে চান না। শ্রমিক সংকট অনেক প্রকট বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের শ্রমিকের সংকট মেশিনই ঘুচিয়ে দিয়েছে। কারখানার প্রতিটি ধাপে আধুনিক নানা প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

গার্মেন্টস সেক্টরে চীনের ব্যাপক হারে অটোমেশনের প্রযুক্তি চলে আসায় তারা ব্যবসার অন্যতম অন্তরায় পার হয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিদেশে চলে যাওয়া বিনিয়োগ দেশে ফিরতে শুরু করেছে। বিশ্ববাজারে চীনের শক্ত অবস্থান অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অপরদিকে বাংলাদেশে হাতগোনা দুয়েকটি কারখানায় আংশিক অটোমেশন হলেও চীনের মতো পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন হওয়া একটি কারখানাও নেই। আর এই অটোমেশনই বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সামনে বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ যতো তাড়াতাড়ি অটোমেশন নিশ্চিত করবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তত দ্রুত নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে বলে মন্তব্য করেছেন জ্যাক কোম্পানির বাংলাদেশের এজেন্ট লায়ন ফজলে করিম। তিনি বলেন, আমাদের কিছু কিছু কারখানা অটোমেশনের চিন্তাভাবনা করছে। প্রযুক্তিতে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে পিছিয়ে পড়া স্বাভাবিক বলেও লায়ন ফজলে করিম মন্তব্য করেন। চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে অন্তত এক লাখ শ্রমিকের সংকট রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সংকট সাবলীলভাবে মোকাবেলা করতে অটোমেশনের কোন বিকল্প নেই।

অটোমেশন করানোর কোন বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএর পরিচালক এবং চট্টগ্রামস্থ সিন সিন গার্মেন্টসের মালিক মোহাম্মদ সোহেল শাহাদাত। তিনি বলেন, ম্যানুয়েলি করতে গিয়ে আমরা খরচ পোষাতে পারছি না। বায়ারও চাপ দিচ্ছেন। তাই নিজের কারখানা অটোমেশন করাতে মেশিন কেনার জন্য তিনি চীনে জ্যাক কোম্পানির কাছে এসেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই গার্মেন্টস সেক্টরে টিকে থাকতে হবে। অটোমেশন না করলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা যাবে না বলেও মোহাম্মদ সোহেল শাহাদাত মন্তব্য করেন।

উল্লেখ্য, রানা ট্রাজেডির পর অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের চাপে বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটি পর্যায়ে এসেছে। এখন নতুন করে প্রযুক্তির আধুনিকায়ন তথা অটোমেশন করতে দেশের গার্মেন্টস মালিকদের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসকালে মা হয়ে খুশিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস, রাতেই মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধআশানুরূপ বুকিং নেই হোটেল মোটেলে